1. numanashulianews@gmail.com : kazi sarmin islam : kazi sarmin islam
  2. admin@newstvbangla.com : newstvbangla : Md Didar
পাপ প্রসঙ্গে লালন - NEWSTVBANGLA
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম
হয় মাদক ছাড়বেন আর না হয় বাড়ি ছাড়বেন-সহকারী পুলিশ সুপার জাকিরুল ইসলাম স্কুল বন্ধে হাইকোর্টের আদেশে অসন্তুষ্ট শিক্ষামন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী ‘প্রতিরোধ যোদ্ধাদের’ চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চার সচিবের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন ভোলায় আজ ৭ হাজার ৭২৫ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ মান্দায় অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত উৎপাদন বাড়াতে চীন থেকে ডিসকাউন্ট মূল্যে আরও কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করা হবে কৃষিমন্ত্রী সারাদেশে দিনে তাবদাহ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে মেক্সিকোতে বাস দুর্ঘটনায় নিহত ১৪ রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম এলাকা হতে ৪০৬ ক্যান বিয়ারসহ ০১ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০ ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগে প্রচণ্ড চাপে নেতানিয়াহু

পাপ প্রসঙ্গে লালন

প্রতিনিধি

 

‘পাপ’ শব্দটির উৎপত্তি এরকম: ‘পা’ মানে রক্ষা করা, ‘প’ অপাদানবাচক শব্দখণ্ড; অর্থাৎ যা হতে রক্ষা করতে হয়। কাকে রক্ষা করতে হয়? আত্মাকে? যা বা যেসব থেকে আত্মাকে রক্ষা করতে হয়, তা-ই পাপ। লালন সাঁই প্রথমত একটি লোকায়ত ধর্মের সিদ্ধপুরুষ। কাজেই তাঁকে পাপ নিয়ে ভাবতে ও বলতে হয়েছে। কারণ ধর্মের একটি প্রধান প্রসঙ্গ পাপ। প্রাচীন ও প্রধান ধর্মসমূহে পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও প্রস্থান দুইক্ষেত্রেই পাপের ভূমিকার কথা বলাহয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যীয় ধর্মমতে আদি মানব-মানবীকে স্বর্গেই রেখেছিলেন সৃষ্টিকর্তা। আর স্বর্গে মৃত্যু ছিল না। কিন্তু স্রষ্টার নিষেধ অমান্য করে একটি বিশেষ ফল খাওয়ার কারণে স্বর্গচ্যুত হয়ে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। এই সূত্রে বলা চলে, পাপ অর্থ স্রষ্টার আদেশ অমান্য করা, যার ফলে মানুষ স্রষ্টার থেকে দূরে সরে যায়। পাপ ধর্মীয় অনুষঙ্গ বলে নৈতিক মানদণ্ড সবসময় আবশ্যক নয়। যদিও বিশ্বাসীরা নিজ নিজ ধর্মের বিধিনিষেধকে নৈতিক বিচারেও যথার্থ মনে করে।

তবে আমরা দেখি, উপাসনা উপচার-প্রকরণ থেকে শুরু করে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো বিষয়ও ধর্মভেদে পাপ ভিন্ন। এবং এই পাপের ফল হচ্ছে ¯্রষ্টা থেকে দূরে সরে যাওয়া। আবার যদিও মানুষ মরণশীল, তবু বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে এসে পাপ করে বলেই তার মৃত্যু ঘটছে। রোমীয় বাইবেলে এক জায়গায় বলা হয়েছে, একজন মানুষ (অ্যাডাম) দ্বারা পাপ ও পাপ দ্বারা মৃত্যু জগতে প্রবেশ করল; আর এই প্রকারে মৃত্যু সমুদয় মানুষের কাছে উপস্থিত হলো, কেননা সকলেই পাপ করল। লালনের গানের বাণীতে বলা যায় : “গরল ছাড়া মানুষ আছে কে রে / সেই মানুষ জগতের গোড়া।” পূর্বোক্ত ধর্মগ্রন্থের অন্যত্র আছে, পাপের মজুরি মৃত্যু।

একথা প্রাবাদিক উক্তি মনে করিয়ে দেয় লালনের গানে কথাটি রয়েছে এভাবে : “লোভে পাপ পাপে মরণ (‘আজ রোগ বাড়ালি শুধু কুপথ্যি করে’)।” ইসলাম ধর্ম মতে মানুষ নিষ্পাপ হয়েই জন্মগ্রহণ করে এবং পৃথিবীতে আবার সেই শয়তানের প্ররোচনায় পাপ করে।

পাপের জন্য মানুষকে শাস্তি পেতে হয় বটে, তবে এই পাপের একটি সদর্থকতাও রয়েছে। যেমন, হাদিসে আছে, “প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে, তাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা তওবা করে (তিরমিজি ২৪৯৯)।” অন্যত্র বলা হয়েছে , “সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, মানুষ যদি পাপ না করতো তবে আল্লাহ মানবজাতিকে তুলে নিয়ে আরেকটি সম্প্রদায় পাঠাতেন যারা পাপ করতো এবং পরে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতো তারপর আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিতেন (সহীহ মুসলিম ৩৭: ৬৬২১)।” ভারতবর্ষীয় সনাতনী বিশ্বাসমতে পুনর্জন্মের পুনরাবর্তন চলছে পৃথিবীতে এবং পাপের কারণে পরবর্তী জন্ম হেয়তর হয়। লালন সাঁই তাঁর গানে প্রসঙ্গক্রমে এসব নিয়ে কথা বলেছেন। সেসব কথায় কখনো কারো পূর্বধারণা পাকাপোক্ত হয়, কখনো এতোদিনের পোষণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

তবে ধর্মবিশ্বাসীমাত্রই পাপভীতি থাকবে। কারণ পৃথিবী পাপের আগার-পাপেরে নিত্য দেখা যায় নানা রূপে, নানা ছলে। পাপের ফাঁদ পাতা ভুবনে মানুষ ধরা পড়ে প্রায়শ। বৌদ্ধ মতানুযায়ী পাপের প্রধান কারণ মায়া। ‘মন ভবে এসে হয়েছি এক মায়ার ঢেঁকি’ গানটি অন্তরায় মানুষকে ‘পাপ-ঢেঁকি’ বলেও রূপকায়িত করেছেন, যে কিনা স্বর্গে গিয়েও একই কাজ করবে বলে লালনের মন্তব্য। সাধারণ পাপতত্ত্বে পাপপ্রবণতার জন্য কয়েকটি উপাদানকে চিহ্নিত করা হয়।

বলা হয় ষড়রিপু বা ছয় শত্র“র কথা। ষড়রিপুসমূহ : কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। লালনের গানে এই ছয় রিপু ছয় মন্ত্রীর রূপকে দেখা দিয়েছে এভাবে : মন্ত্রী ছয়জনা সদায়/ অশেষ কুকা- বাঁধায়/ ডুবালো ঘাট অঘাটায়/ আজ আমারে (‘পার করো দয়াল আমার কেশে ধরে’)”। কখনো আবার এদের সঙ্গে মিলেছে দশ ইন্দ্রিয়। এই দশটি ইন্দ্রিয় আবার দুভাগে বিভক্ত-দেহোন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়। দেহোন্দ্রিয় হচ্ছে : কান, চোখ, নাক, জিহ্বা ও ত্বক; কর্মেন্দ্রিয় : বাক, পাণি, পাদ, পাহু ও উপস্থ। এই ষোলজনের কারণে দুর্বলচিত্ত মানুষের যে দুরবস্থা হয়, তা লালনের ভাষায়: “শহরে ষোলজন বোম্বেটে/ করিয়ে পাগলপারা নিল তারা সব লুটে।”

অশুভশক্তির প্রবলতা কিংবা মানবচিত্তের দুর্বলতার কারণেই হোক, মানুষ পাপ কওে আসছে। পাপ করার সে সরল স্বীকারোক্তি আর মুক্তির জন্য হাহাকার লালনের অনেক গানেই আছে। যথা :

# আমায় চরণ-ছাড়া করো না হে দয়াল হরি/ আমি অধম পামর বটে দোহাই দেই তোমারি।
# আমি অধম ডাকছি তোমায় (‘আমার দিন কি যাবে এই হালে’)
# পাপ করো ক্ষমা/ এই পাপীর হও সদয় (‘আশাসিন্ধু তীরে বসে আাছি’)
#আর কি এই পাপীর ভাগ্যে দয়াল চাঁদের দয়া হবে (‘এই দেশেতে এই সুখ হলো’)

এই যে পাপী হওয়ার স্বীকারোক্তি, সে তো আসলে অনুতাপ আর অনুতাপ তো ধার্মিকের হৃদয়েই জন্মায়। আর ধর্মীয় বিশ্বাসের আশ্বাসেই পুণ্য করে যতোটা নয়, তার চেয়ে বেশি মাফ পেয়ে মুক্তি চায় মানুষ। ¯্রষ্টার প্রেমময় দরদি সত্তাও ভক্তকে মাফ করার জন্য সদা প্রস্তুত। ক্ষমাশীল আল্লাহ ‘ডুবায়ে ভাসাইতে পারেন’ কাউকে, কাউকে বা ‘ভাসায়ে কিনার’ দেন। লালন নিজের মুক্তির জন্য তার উদাহরণ দিয়ে বলেছেন : “নিজাম নামে বাটপার সে তো, পাপেতে ডুবিয়া রইত/ তার মনে সুমতি দিলে, কুমতি তার গেল চলে (‘এলাহি আলামিন গো আল্লাহ’)।”

লালন অনেক গানেই পতিতপাবন শব্দটি ব্যবহার করেছেন : “পাপ ও পুণ্য যতই করি? ভরসা কেবল তোমারই…পুরাণে শুনেছি খবর/ পতিতপাবন নামটি তোমার/ লালন বলে আমি পামর/ তাইতে দোহাই দেই বটে (‘এসো দয়াল, পার করো ভবের ঘাটে’)।”

আরেকটি গানে :
পাপী অধম জীব হে তোমার
তুমি যদি না করো পার
দয়া প্রকাশ করে
পতিতপাবন পতিতনাশা
বলবে কে আজ তোমারে (‘পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে’)।

তবে বাউলমতে মিথুনাত্মক সাধনার মধ্য দিয়ে একজন সফল সাধকের দেহে পরম সত্তার আগমন ঘটে, খণ্ডাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন হয়। তখন সেই সিদ্ধসাধকই পরমসত্তায় পরিণত হয়। এরকম এক সিদ্ধপুরুষকেই গুরু মানতে হয় এবং সেই গুরু সমস্ত পাপ-তাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন। এটি পিরবাদের চেয়ে অধিক কিছু, সুফিবাদের সাথেই যার সমিল প্রায় শতভাগ।

পির হচ্ছেন সুপারিশকারী আর সুফিসাধক নিজে ফানাফিল্লাহ। বাউলের গুরু তেমনি উচ্চস্তরে পৌঁছে গেছেন অর্থাৎ স্বামী বা সাঁই হয়েছেন, কাজেই তিনি নিজেই মুক্তিদাতা। তাই লালনের সাবধানবাণী : “গুরুবস্তু চিনে নে না/ অপারের কাণ্ডারি গুরু তা বিনে কেউ কুল পাবা না।” গুরুর কাছেই প্রার্থনা : “গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার নেও গো সুপথে।” বা “গুরু গো মনভ্রান্তি যায় না এ সংসারে/ মন ভ্রান্ত কর শান্ত, শান্ত হয়ে রই ঘরে।”

ইসলাম-ব্যাখাতাদের কাছে সুপারিশনির্ভর পিরবাদ প্রশ্নবিদ্ধ আর কাউকে মুক্তিদাতা গণ্য করা তো শিরকের পর্যায়ে পড়ে। শিরক মহাপাপ। আল্লাহ ছাড়া অপর কারো কাছে অবনত হওয়া বা কাউকে সেজদা করা শিরক। কিন্তু কোরানে আছে, আল্লাহ মাটির মানুষকে সেজদা করার জন্য আগুনের ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিষয়টিকে লালন ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :

আল্লা আদম না হইলে
পাপ হইত সেজদা দিলে
শেরেকি পাপ যাকে বলে
এ দীন দুনিয়ায় (’আপন ছুরতে আদম গঠলেন দয়াময়’)
সিজদার এই লালনীয় বা বাউলি-ব্যাখ্যা অবশ্য তওহীদবাদে বিশ্বাসীরা সমর্থন করে না।

আবার ধর্মভেদে পাপতালিকায় ভিন্নতা রয়েছে। সমিল যেখানে আছে তা মূলত নৈতিক। লালনের পাপতত্ত্বেও এগুলোকে পাওয়া যাবে। যেমন লালনের বিখ্যাত গানটিতে রয়েছে : “সত্য বল, সুপথে চল ও রে আমার মন/ সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।” কাজেই মিথ্যা বলা, কুপথে গমনের মতো বিষয় লালন বা বাউল ভাবনায়ও পাপ। এই গানে লালন আরো গেয়েছেন : “ফড়িয়া মহাজন যে-জন/ তার বাটখারাতে কম/ তারে কসুর করবে যম…পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ কোরো না/ পারে যেতে পারবে না/ যতবার করিবে হরণ/ ততবার হবে জনম (‘সত্য বল সুপথে চল’)।”

এ জাতীয় মূল্যবোধসম্পন্ন নীতিনির্ভর প্রসঙ্গ ছাড়া আচরিক দিকগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের বিধিবিধানের মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, বিবাহের ক্ষেত্রে আত্মীয়সম্পর্কের প্রশ্নে, উত্তরাধিকারী নির্বাচনে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। এখানে নিরীশ্বরবাদী দার্শনিকদের ন্যায় লালনের প্রশ্ন : “এক যুগে পাঠায় কালাম/ অন্য যুগে হয় কেন হারাম (‘কী কালাম পাঠালেন আমার সাঁই’)।” তবে এসব বিষয়ে নিজ ধর্মসম্প্রদায়ের নির্দেশনার বাইরে যাওয়া মানেই পাপ। অথচ এই আচরিক দিক অনেক সময়ই স্থানিক বা কালিক সূত্রে এসেছে। সেই অষ্টাদশ শতকের উপান্তেই কিন্তু লালনের মতো এক নিরক্ষর গ্রামীণ কবি বিষয়টা ধরতে পেরেছিলেন। তাই বলেছেন :

পাপ-পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই
এই দেশে যা পাপ গণ্য অন্য দেশে পুণ্য তাই ॥

যেমন, তিব্বতে নারীর একাধিক স্বামী; এদেশে ব্যাপারটি ব্যভিচার। এই গানে খাদ্যসম্পর্কিত বিধি বিষয়েও বলেছেন : “শূকর গরু দুইটি পশু/ খাইতে বলেছেন যিশু/ তবে কেন মুসলমান হিন্দু/ পিছেতে হটায়॥” অবশ্য মুসলমানরা গরু খায়, হিন্দুর সেখানেও আপত্তি। তবে যুক্তিবাদী লালনের বক্তব্য : “দেশ সমস্যা অনুসারে/ ভিন্ন বিধান হতে পারে/ সূক্ষ্ম জ্ঞানের বিচার করে/ পাপপুণ্যের নেই বালাই॥”

এ গেল সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের কথা। এরপর ধর্মীয় বিধি বিষয়েই তাঁর কিছু মতামত রয়েছে। যেমন বলছেন : “রোজা-পূজা করলে সবে/ আত্ম সুখের কার্য হবে/ সাঁইর করণ কি সই বরিবে/ মনে ভাব তাই (‘শুদ্ধ প্রেমরসের রসিক মেরে সাঁই’)।” ‘শুনি নবির অঙ্গে জগৎ পয়দা হয়’ গানটিতে পাপপুণ্যের জন্য শাস্তি-শান্তি প্রদান নিয়ে যুক্তিবাদীর মতো প্রশ্ন করেছেন : “একজানে দু’কায়া ধরে/ কেউ পাপ কেউ পুণ্যি করে/ কী হবে তার রোজ হাশরে/ নিকাশের বেলায়।” মরমিসাধক লালনের যুক্তিপূর্ণ আরেকটি প্রশ্ন :

যদি যখনকার পাপ তখন ভুগি
শিশু কেন হয় সে রুগী
লালন বলে বোঝো দেখি
কখন হয় শিশুর গুনাখাতা॥ (‘কারে আগে শুধাই সে কথা’)

বিপরীতক্রমে লালনের ভাবনা, যে গুনাহ করে তার মৃত্যু হওয়ার পর অন্যেরা কীভাবে তার পাপক্ষালন করাতে পারে। এক্ষেত্রে প্রার্থনা করে ও আহার্য-সাহায্য দিয়ে অর্থাৎ ইসলামী পরিভাষায় যাকে ‘ফয়তা’ দেওয়া বলে তার যাথার্থ্য নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন :“মুরদার নামে ফয়তা দিলে/ মুরদা কি পায় সেখানে গেলে/ তবে কেন পিতা পুত্রে / দোজখে যায় (‘পেঁড়োর ভূত হয় যে জনা’)।” পাপকর্ম সম্পর্কে আরেকটি বিবেচ্য বক্তব্য দিয়েছেন লালন সাঁই। এখানে তাঁর বিবেচনা অনেকটা দর্শনশাস্ত্রের আত্মার স্বাধীনতা প্রসঙ্গের ন্যায়। মুসলিম দার্শনিক গোষ্ঠি আশায়েরাদের মতো তিনি বলেন :

পাপধর্ম যদি পূর্বে লেখা যায়
কর্মে লিখন কাজ করিলে দোষগুণ কী হয়॥

লক্ষণীয়, লালন এসব ক্ষেত্রে দর্শনের প্রথম পর্যায় যুক্তি-উপস্থাপনের জন্য প্্রশ্নপদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। হতে পারে, জিজ্ঞাসু লালনের নিজের মনে প্রশ্নগুলো ঘোরাঘুরি করেছে। সেসময় বাহাস-বিতর্কে অংশ নিতে গিয়েও এভাবে কথা বলতে হতে পারে। তবে তাঁর এসব প্রশ্ন বা যুক্তি একেবারে উপেক্ষণীয় নয়।

শেষত বলতে পারি, বাউল ধর্মবিশ্বাসী সাধকের মতো লালন সাঁই প্রথম পর্যায়ে নিজেকে পাপী জ্ঞান করেছেন, পাপের কারণে হাহাকার করেছেন, উত্তরণের জন্য উন্মুখ হয়েছেন। কিন্তু যখন তিনি একজন চিন্তাশীল, জিজ্ঞাসু, আধুনিক মানুষ Ñজড়বাদী, যুক্তিবাদী অথবা সংশয়বাদীÑ হয়েছেন, তখন পাপপুণ্য আর তার শাস্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এটা লালন শাহের অসঙ্গতি নয়, অনন্যতা। এ-কারণেই একটি লোকায়ত ধর্মের সাধক হিসেবে সীমিত পরিচয় থেকে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে। সংগীতকার লালন দার্শনিক মনীষা হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2015
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তাহোস্ট