চাঁদপুর জেলার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের ঐতিহ্য রয়েছে। যার ফলে এই এলাকায় ভারতীয় মুসলমানদের আগমন ঘটে। তারা অস্থায়ীভাবে এই জেলায় অবস্থান করলেও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে যায়। ওইসব স্থাপনার অংশই হচ্ছে জেলার বিভিন্ন এলাকায় চুন-সুরকি দিয়ে তাদের তৈরি করা মসজিদ। মুঘল আমলের মসজিদ নামে এসব স্থাপনাগুলো পরিচিত। তেমনি চাঁদপুর সদর উপজেলার বাখরপুর গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪শ’ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের ধারক বাখরপুর জামে মসজিদ। গায়েবি মসজিদ নামেও স্থানীয়ভাবে পরিচিত এটি।
জেলা সদর থেকে এই মসজিদের গুরুত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সদরের দক্ষিণে সদর-হাইমচর সড়ক হয়ে চান্দ্রা বাজার চৌরাস্তা থেকে দক্ষিণে বাখরপুর গ্রাম। মূল সড়ক থেকে গ্রামীণ সড়ক দিয়ে চান্দ্রা ইউনিয়নের বাখরপুর পশ্চিম পাড়ায় মেঘনা নদীর খুব নিকটেই মসজিদের অবস্থান।
এই মসজিদের নির্মাণ সালের সঠিক তথ্য সংরক্ষিত নেই এবং পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা ও প্রবীণ লোকদের মতে মুঘল আমলেই এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছে।
মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজে জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন মুসল্লি নাজির পাটওয়ারী (৬৫)। তিনি বলেন, মসজিদ কমপ্লেক্সটি ২৮ শতাংশ জমির ওপর। এর মধ্যে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ভবনটি ৬ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত। এরপর বিগত প্রায় ৩০ বছর পূর্বে মসজিদের মুসল্লি সংকুলান না হওয়ার কারণে মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব দিকে ৮ শতাংশের মধ্যে পাঁচতলা ভিতের ওপর একতলা ভবনের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পাশে ঈদগা ও পুকুর মিলিয়ে রয়েছে ১৪ শতাংশ জায়গা।
মুগল আমলের নকশায় মসজিদটি তিন গম্বুজ ও ৩ তারা বিশিষ্ট। আর এই নির্মাণ কাজ হয় শুধুমাত্র চুন-সুরকি দিয়ে। পুরো মসজিদের চারপাশে ২৮টি চুন-সুরকির তৈরি খুঁটি রয়েছে। আর এই খুঁটির সঙ্গে দেয়ালের পুরুত্ব সোয়া ৩ ফুট। পাঁচটি দরজা ও মূল মিম্বারের দুই পাশে দুটি মেহরাব। রয়েছে সোয়া ৩ ফুট পুরুত্বের জুল বিম দুটি। মসজিদটি যখন নির্মাণ হয়, তখনকার নির্মাণ শৈলী অনেকাংশে এখন আর নেই। শুধুমাত্র তিনটি গম্বুজের ভেতরের অংশে বিভিন্ন রঙের কিছু হাতে তৈরি নকশা রয়েছে।
মসজিদের মূল অংশে প্রায় দেড় শতাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। বর্তমানে বর্ধিতাংশসহ প্রতি জুমায় প্রায় ৩০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
নাজির পাটওয়ারী বলেন, আগে সংস্কার না করায় মসজিদের ওপরে বিভিন্ন ধরনের গাছ ও আবর্জনা ছিল। অনেকের কাছেই এটি জিনের কিংবা গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত। যে কারণে একসময় ভয়ে লোকজন মসজিদের কাছে খুব কম আসত। মূলত এই এলাকাটি মেঘনা উপকূলীয়। নদী ভাঙনে অনেক পরিবার নিজ বসতি ছেড়ে অন্যস্থানে বসতি গড়েছেন। তবে প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগ থেকেই এটি সংস্কারে এলাকার লোকজন এগিয়ে আসেন।
মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি হাফেজ আহম্মেদ পাটওয়ারী বলেন, এই মসজিদ নির্মাণের প্রকৃত সাল তারিখ কেউ বলতে পারে না। তবে আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানতে পারি মুঘল সাম্রাজ্যের আমলে বণিকরা এই দেশে ব্যবসা করতে আসে, তখনই তারা এসব মসজিদ নির্মাণ করে। এই মসজিদের অনেক ঐতিহ্য ও সুনাম রয়েছে। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে মসজিদটি দেখার জন্য ছুটে আসে। অনেকে আবার নিয়ত-মানত করেন।
মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক মো. ইউসুফ গাজী বলেন, অনেকেই এই মসজিদকে গায়েবি কিংবা জিনের মসজিদ বলেন। আসলে তা নয়, তবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেও নির্মাণসাল জানা যায়নি। অনেকের মতে এটি মুঘল আমলেই তৈরি। তখন পুকুর খনন করে তার ওপর চুন ও সুরকি ব্যবহারে পুরো মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এতে কোনো ধরনের রড ও সিমেন্ট ব্যবহার হয়নি। তবে গত প্রায় ৩০-৩৫ বছর পূর্বে চুন ও সুরকির দেয়াল থেকে পানি চুয়ে চুয়ে পড়ার কারণে এটি উন্নয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই আলোকে মূল স্থাপনা ঠিক রেখে ওপরে টাইলস বসানো হয়।
তিনি আরও বলেন, মসজিদ কমিটির সভাপতি মওদুদ আহম্মেদ দুদু খানসহ আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করেছি। এতে স্থানীয় মুসল্লিদের দান-অনুদানের পাশাপাশি সরকারিভাবে পুকুরঘাট ও ঈদগা নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে প্রায় ৯ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি।
গত দুই মাস পূর্বে এই মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে যোগ দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ বালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা শফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই এই মসজিদ স্থানীয়দের কাছে বেশ পরিচিত। অনেক লোক দূর থেকে এই মসজিদ দেখার জন্য আসেন এবং এখানে এসে নামাজ পড়েন। সাধারণ মানুষ এই মসজিদকে উচিলা করে নিয়ত-মানতও করেন। ওইসব লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেছে তাদের উপকার হয়েছে। এই মসজিদের খেদমত করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাখাওয়াত জামিল সৈকত বলেন, বাখরপুরে এই ধরনের একটি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী মসজিদ আছে জেনেছি এবং মসজিদটি দেখতে খুবই সুন্দর। এই মসজিদ আরও কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, সেটি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এবং মসজিদ যাতায়াতের রাস্তাটি সংস্কারের জন্য দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই বিষয়ে আমি ওই ইউনিয়নের প্রশাসককে অবগত করব।