মোঃ আব্দুল্লাহিল কাফী, অতিথি লেখকঃ মোস্তফা রনি। জন্ম মগবাজারে। তিন ভাইবোনের মধ্যে মোস্তফা রনি বড়। দুইবোন ছোট। মোস্তফার বয়স যখন দশ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। সংসার সামলানোর পুরো দায়িত্ব পড়ে ছোট্র মোস্তফার কাঁধে। ছোট দুইবোন ও অসুস্থ মায়ের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে মোস্তফা কাজ নেয় কাওরান বাজারে ডাবের আড়তে। ভোর তিনটা রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত কাজ। বিভিন্ন এলাকা থেকে আড়তে আসা ডাব বোঝাই ট্রাক থেকে ডাব নামানো, ভ্যানগাড়িতে ফেরি করে ডাব বিক্রেতাদেরকে গুনে গুনে ডাব দেওয়া এবং সন্ধ্যার পর থেকে ডাব নেওয়া সেই ভ্যানগাড়ির মালিকদের কাছ থেকে ডাবের মূল্য সংগ্রহ-এই ছিল তার কাজ। ভ্যানগাড়িতে দেওয়া সব ডাব বিক্রি হয়ে গেলে টাকা তুলতে বেজে যায় এগারোটা। বিক্রি না হলে আরো গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়। হিসেব রাখতে হয় অবিক্রিত ডাবের। মালিকের দয়া হলে বাসায় যাওয়া হয়, অন্যথায় ডাবের আড়তেই কাটাতে হয় রাত। মাসিক বেতন আট হাজার টাকা। বেতন পেয়েই সোজা মায়ের হাতে। মায়ের চিকিৎসা ও দুই বোনের পড়াশোনাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ এই টাকাতেই চলতো।
সংসারের ঘানি টানতে ক্লান্ত মোস্তফাকে একটু প্রশান্তি দিতে অসহায় মায়ের চেষ্টার কমতি ছিল না। ছেলের বেতনের আট হাজার টাকায় সংসার চালিয়ে সঞ্চয়ও করেছিলেন কিঞ্চিৎ। শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি থেকে যৎকিঞ্চিৎ যা পেয়েছিলেন তা বিক্রি করে এবং উচ্চ সুদে ঋন নিয়ে ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবে পাঠান মোস্তফাকে। সেখানে ক্লিনার হিসেবে দুই বছর কাজ করে ঋন শোধের পর জমানো টাকায় বিয়ে দেয় দুইবোনের বড়টাকে। বিয়ে করে নিজেও।
অবশিষ্ট টাকায় পাড়ি জমায় দুবাইয়ে। দুবাইয়ে একটি সরকারী অফিসে কাজ পায় ‘অফিস বয়’ হিসেবে। সেই অফিসে কাজ করে সাত বছর। সততা ও বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে সেই অফিসের একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা মোস্তফাকে পরিচয় করিয়ে দেন এক জাপানি নাগরিকের সাথে। মোস্তফা তার কাছে জাপানি প্রতিষ্ঠান ‘জেটি মেট্রো’তে ২৫০ জন বাংলাদেশী শ্রমিক সরবরাহের কন্ট্রাক্ট পায়। জেটি মেট্রো ঘন্টা প্রতি একজন শ্রমিকের মজুরি তেরো দিরহাম দিতে রাজি হয়। দুবাইয়ে বাংলাদেশী শ্রমিকরা তখন ঘন্টা প্রতি ছয় দিরহামেই কাজ করতো।
মোস্তফার চোখে তখন দিন বদলের স্বপ্ন। যে স্বপ্নে বিভোর মোস্তফা সেই দশ বছর বয়সে কাওরান বাজারের ডাবের আড়ত থেকে সৌদি আরব হয়ে আজ দুবাইয়ে। নিজের সঞ্চয়, দেশে মা-বোনের কাছে পাঠানো টাকা ফেরত নিয়ে এবং উচ্চ সুদের ঋনের টাকায় ‘জেটি মেট্রো’তে শ্রমিক সরবরাহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মোস্তফা। স্বপ্নে বিভোর মোস্তফা ভূলেই গিয়েছিল দুবাইয়ে তার ভিসার মেয়াদ শেষ। ভিসা জটিলতায় দুবাই সরকার ২০০৭ সালে দেশে ফেরত পাঠায় মোস্তফাকে।
মোস্তফা আর দুবাইয়ের ভিসা পান নি। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দুবাইয়ের এক এজেন্টকে দশ হাজার দিরহাম দিয়েছিল মোস্তফা। জীবনের সমস্ত সঞ্চয় ও ঋনের টাকায় গোছানো শ্রমিক সরবরাহের অসম্পূর্ণ কাজটাও বুঝিয়ে দিয়েছিল তাকে। সে আর যোগাযোগ করে নি। মোস্তফাও বহুবার চেষ্টায় তার সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি।
সব হারিয়ে মোস্তফার তখন পথে বসার অবস্থা । এক পর্যায়ে কাকরাইল মসজিদের সামনে আতর বিক্রির কাজ শুরু করে। সুবিধা করে উঠতে পারে নি। বাজার খরচ বা অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা তো দূরের কথা, বাচ্চার দুধ কেনার সামর্থও ছিল না।
৫ জুলাই’ ২০০৯ খ্রি. রবিবার। মগবাজারের স্থানীয় লোকজনের মুখে মোস্তফার এই দুরবস্থার কথা শুনে ঢাকা ১২ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান খান কামাল মোস্তফাকে তার বাসায় ডাকেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল মোস্তফাকে একটি ভ্যানগাড়ি কিনে দেন। তাঁর সহধর্মিনী নগদ ১৬ হাজার টাকা দেন মোস্তফাকে।
১৬ হাজার টাকায় পুরাতন একটি ফ্লোর ক্লিনিং মেশিন কেনে মোস্তফা। নিজে ভ্যান চালিয়ে সেই মেশিন নিয়ে কাজে যায় মোস্তফা। গুলশানে প্রথম ছয়শত টাকায় টয়লেট ক্লিনিংয়ের কাজ পায়। গুলশান-বনানী এলাকায় ভ্যান চালিয়ে দ্বারে দ্বারে অনুরোধ করে কার্পেট, সোফা, ফ্লোর, টয়লেট, গ্লাস, কিচেন ক্লিনিং ও পেস্ট কন্ট্রোলের কাজ করতে থাকে মোস্তফা।
হাতিরঝিলে এক ব্যবসায়ীর বাসায় ক্লিনিংয়ের কাজ চেয়ে বারবার অনুরোধের প্রেক্ষীতে বিরক্ত হয়ে সেই ব্যবসায়ী মোস্তফাকে চট্রগ্রামের আগ্রাবাদে তার ৩২ তলা ভবনের আউট সাইড গ্লাস ক্লিনিংয়ের কাজ করতে বলেন। সেই ব্যবসায়ীর ধারনা ছিল মোস্তফার পক্ষে এটা অসম্ভব। এই কাজের প্রস্তাব শুনে মোস্তফা আর বিরক্ত করবে না। তবে মোস্তফা এই কাজকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়।
সেই থেকে শুরু। আগ্রাবাদের ৩২ তলা ভবনের কাজে মোস্তফা পারিশ্রমিক পায় দশ লক্ষ। এরপর বনানীতে একটি ২০ তলা ভবনের কাজে ১৬ লক্ষ। আকিজ গ্রুপের ৩৫ টি কোম্পানিতে ক্লিনিংয়ের জন্য স্থায়ীভাবে চুক্তিবদ্ধ হয় মোস্তফার পাওয়ার প্রোপার্টি কেয়ার সার্ভিস লিমিটেড। দম ফেলার ফুরসৎ নেই মোস্তফার।
ক্লিনিংয়ে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায় মোস্তফা রনির ‘পাওয়ার প্রোপার্টি কেয়ার সার্ভিস লিমিটেড’। যে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান স্টাফ সংখ্যা চারশত জন। এই স্টাফদের বেশীরভাগই এক সময় মাদকাসক্ত ছিল। মগবাজার এলাকার মাদকাসক্তদের খুঁজে খুঁজে বের করে নিজের ক্লিনিং কোম্পানিতে নিয়োগ দেয় মোস্তফা। এককালের মাদকাসক্তদের সম্মিলিত প্রয়াসেই প্রস্ফুটিত মোস্তফার আজকের চারশত জনবলের ‘পাওয়ার প্রোপার্টি কেয়ার সার্ভিস লিমিটেড’।
২০১৯ সালের শেষের দিকে মগবাজারের গাবতলায় অফিস নেয় মোস্তফা। শুরু করে অফিস ডেকোরেশনের কাজ। তার স্বপ্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উদ্ধোধন করবেন তার অফিস। তবে অফিস ডেকোরেশনের কাজ শেষ হতে হতে দেশে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকে।
অফিস রেডি হলেও মোস্তফা বসে নি সেই অফিসে। যে আসাদুজ্জামান খান কামালের দেওয়া ভ্যানগাড়ি ও তাঁর সহধর্মিনীর দেওয়া ১৬ হাজার টাকায় খুলে গিয়েছে মোস্তফার ভাগ্যের চাকা, তাঁর পদধূলি পড়ার আগে মোস্তফা সেই অফিসের চেয়ারে বসবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। স্থানীয় লোকজনের মুখে মোস্তফার এই প্রতিজ্ঞার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজেই হাজির হন মোস্তফার অফিসে।
১৬ মার্চ’ ২০২২ খ্রি. বুধবার। বিকেল পাঁচটা। মোস্তফার স্বপ্ন পূরনের দিন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উদ্ধোধন করেন মোস্তফার অফিস। মোস্তফা ও তার সহকর্মীদের কর্মতৎপরতা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। মোস্তফার উদ্যম ও কর্তব্যনিষ্ঠাকে নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরনার উৎস বলে উল্লেখ করেন তিনি।
লেখকঃ
মোঃ আব্দুল্লাহিল কাফী পিপিএম (বার)
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ঢাকা জেলা।