মুন্সীগঞ্জে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আলু উৎপাদন বেশি হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত আলু নিয়ে মহাসংকটে পড়েছেন কৃষকরা। একদিকে দাম না থাকায় যেমন জমি থেকে বিক্রি করতে পারছেন না, অন্যদিক হিমাগারগুলোতেও আলু রাখার জাগার সংকুলান না হওয়ায় উৎপাদিত আলু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
হিমাগারে রাখার জন্য দিনের পর দিন আলুবোঝাই ট্রাক, লরি, ট্রলি নিয়ে হিমাগারের সামনে দীর্ঘ লাইন ধরে আছেন কৃষকরা, কিন্তু আলু রাখতে পারছেন না। তারা অভিযোগ করে বলেন, আলু মজুদদাররা উত্তরবঙ্গ থেকে আলু এনে হিমাগার দখলে রেখেছেন। মুন্সীগঞ্জে আলু উত্তোলন শুরুর আগে থেকেই উত্তরবঙ্গ থেকে ট্রাক ভরে আলু আনতে দেখা গেছে কতিপয় আলু ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকদের। আগেই হিমাগার ভরে যাওয়ায় এখন স্থানীয় বাসিন্দারা আলু রাখার জায়গা পাচ্ছেন না।
সরেজমিনে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার রসুলপুর, সদর উপজেলার মুক্তারপুর, টঙ্গীবাড়ি উপজেলার হাসাইল, দিঘিরপাড়, কামারখাড়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সারিবদ্ধ ট্রলারে আলু নিয়ে কয়েকদিন ধরেই বসে আছেন কৃষকরা। আলু নিয়ে হিমাগারের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া গাড়ি বাড়তি চাপের কারণে পুনরায় ঘাটে আসতে দিন পাড় হয়ে যাচ্ছে। ঘাটের শ্রমিকরাও অলস সময় পাড় করছেন। এতে কৃষকদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ট্রলার চালক, লেবার ও গাড়িচালক।
কৃষক জুয়েল তালুকদার বলেন, গাড়ি না পাওয়ায় দিনের পর দিন ঘাটেই আলু নিয়ে বসে থাকতে হয়। গরমে আলুর পচন ধরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। স্টোর মালিকরা ইচ্ছা করেই লেবার কম নিয়া আমাদের ভোগান্তিতে ফেলছেন। আবার অনেক স্টোর মালিক জায়গা সংকট জানিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন কৃষকদের।
ট্রলার চালকরা জানান, একবার মাল নিয়ে যদি ঘাটে বসে থাকি তাহলে যেই টাকা ইনকাম করবো সেই টাকাতো এখানেই শেষ করে খালি হাতে বাড়ি যেতে হবে। ঘাটের শ্রমিকরা জানান, সকালে এক গাড়ি মাল উঠালে ৩ ঘণ্টা পর গাড়ি আসে, আর আমরা এখানে বসে বসে বেকার সময় কাটাই।
ট্রাকচালক আফজাল হোসেন বলেন, আলু নিয়ে স্টোরে গেলেই স্টোর মালিকরা বলেন স্টোর ভরে গেছে আলু নিয়া আইসেন না। এক গাড়ি আলু নিয়া স্টোরে গেলে সেই আলু নামিয়ে আসতে আবারও রাত হয়ে যায়। সারাদিন এক গাড়ি আলু নামালে খরচও ওঠে না। আমাদেরও তো সংসার আছে। কৃষকরা আরও বলছেন, আলু ১০-১২ টাকা কেজি তাও কেনার মতো পর্যাপ্ত ক্রেতা নাই। কৃষক কয় টাকা কেজি দরে বিক্রি করবে, সরকার তা নির্ধারণ করে দিলো ভালো হতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর মুন্সীগঞ্জ জেলার ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর বেশি। এ ছাড়া সারাবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার উৎপাদনও হয়েছে বেশি। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর আলু উৎপাদন করতে ১৮ থেকে ২০ টাকা কেজিতে খরচ হয়েছে। অথচ আলু এখন ১০-১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঘাম ঝড়িয়ে চাষ করা ফসলের বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্য দাম নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা। এবার হিমাগার ভাড়া দেড় থেকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে প্রতি কেজি ৮ টাকা নির্ধারণ করেছে হিমাগার সমিতি। গত বছরও ৫০ কেজির প্রতি বস্তার ভাড়া ছিল ২০০ থেকে ২৫০। এবার তা ৪০০ টাকা ঘোষণা করেছে হিমাগার সমিতি। এতে ক্ষুব্ধ কৃষকরা। এ অবস্থায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় হিমাগার চালুর দাবি তাদের।
মুন্সীগঞ্জে সচল ৫৮ হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৫ লাখ ৪০ হাজার ৭৬০ টন। আর এবার জেলায় আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১০ লাখ টন। বাকি আলু কৃষক জমিতে এবং বাড়িতে সংরক্ষণ করেন এবং জমি হতে বিক্রি করে থাকেন। তবে কৃষকদের দাবি উত্তরাঞ্চল হতে আলু এনে আলু ব্যবসায়ীরা মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলো আগেই ভরে ফেলেছেন। তারা ঠিকমতো আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলার মুক্তারপুরের কদম রসুল কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার দুলাল মণ্ডল বলেন, আগে যা ভাড়া রাখতাম, তার চেয়ে বেশি খরচ হয়। এ কারণে এ মৌসুমে ভাড়া বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।
টঙ্গীবাড়ি উপজেলার সিদ্ধেশ্বরী কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার ফখরুল বলেন, আমাদের স্টোরে ১৩ হাজার মেট্রিক টন আলু রাখার জায়গা আছে। অলরেডি ৯ হাজার মেট্রিকটন আলু রাখা হয়েছে। আমাদের স্টোর প্রায় ভরে গেছে। হয়তো আর দু-এক দিন আলু ভরা যাবে।
টঙ্গীবাড়ি উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উপজেলার মোট ২৮টি হিমাগারের মধ্যে ২৬টি সচল রয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী ১৯ মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার ৭ মেট্রিকটন আলু হিমাগারগুলোতে তোলা হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে কোল্ড স্টোরেজের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। ভাড়া রিভাইস (পুনর্মূল্যায়ন) করার আহ্বান জানিয়েছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সামির হোসেন সিয়াম বলেন, খরচটা বেশি হয়ে গেছে। তারাও তাদের সমস্যার কথা আমাদের জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আমরা কোনো সহায়তা করতে পারি কিনা, সে চেষ্টা চলছে।