বৃহস্পতিবার , ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ৮ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

সংস্কৃতির বৈশাখ

প্রকাশিত হয়েছে- রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১৮

 

নববর্ষ উদযাপন বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। পহেলা বৈশাখের সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ এ আনন্দযজ্ঞে বাঙালির প্রাণ জেগে ওঠে। একটি নতুন বছরের শুভসূচনায় পোশাকে-খাবারে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, শুভেচ্ছা আদানপ্রদানে দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ রূপ লাভ করে। সম্প্রতি বছরগুলোতে বৈশাখকে কেন্দ্র করে নগর থেকে গ্রাম সর্বত্র মানুষের যে ক্রমবর্ধমান জাগরণ তা অভূতপূর্ব। আমরা ‘খাঁটি ও নির্ভেজাল’সংস্কৃতি চর্চার আনন্দ স্মৃতি ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় দিনটি অতিবাহিত করি। ফলে, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিষয়টি আমাদের সম্মুখে চলে আসে। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে বাঙালি সংস্কৃতির আসল রূপটি উদ্ধার বা আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়ে উঠি।

বোধ করি, অবিমিশ্র সংস্কৃতি বলে কিছু নেই, আছে সংস্কৃতির নানা অবস্থা। সংস্কৃতির সৃষ্টি আছে, বিকাশ আছে, বিলুপ্তিও আছে। সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে, এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উত্তরণ কিংবা অবনমনও হয়। চলমানতা বা বিবর্তন সংস্কৃতির ধর্ম। ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ পরিগ্রহ কিংবা নবজন্ম লাভ করা সংস্কৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বলা হয়, মানুষ যা তা-ই সংস্কৃতি। সে যা করে তা যেমন সংস্কৃতি, যা ভাবে তা-ও সংস্কৃতি।

কাজের মাধ্যমে সৃষ্ট বস্তুর জগৎ এবং ভাবনার মাধ্যমে জাত ভাবসম্পদও সংস্কৃতি। মানুষ সংস্কৃতি সৃষ্টি করেন এবং সংস্কৃতির মধ্যেই বসবাস করেন। নির্দিষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে জীবনযাপন করতে মানুষ স্বস্তি বোধ করেন। সংস্কৃতি তাকে লালন করেন, বাঁচিয়ে রাখেন, বিকশিত করেন; মুক্তির পথ দেখান, সুন্দর, কল্যাণ ও পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করেন। আবার সংস্কৃতি মানুষকে অন্ধ এবং বন্ধও করেন। প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থান হয় জীবনের বিপরীতে। সংস্কৃতির তাই দুই রূপÑমুক্তির সংস্কৃতি ও বন্ধনের সংস্কৃতি। একটি আলোর অভিযাত্রী, অন্যটির গন্তব্য অন্ধকারের দিকে।

বাঙালিরা অস্ট্রিক-মোঙ্গলদের বংশধর। নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য তার পরিচয় বহন করে। বাঙালির ভৌগোলিক অবস্থান, প্রধানত পলি মাটির বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি, জালের মতো ছড়ানো নদী, মৌসুমি জলবায়ুর এই নিম্নভূমির দেশে ছায়াপ্রদায়ী সবুজ বৃক্ষের নিচে বাঙালির বসবাস কয়েক হাজার বছর ধরে। জলবায়ু, নদী, পলি মাটি এবং নৃ-তাত্ত্বিক গঠন সবই তার সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

বাঙালির ঘরবাড়ির গঠন, জীবনযাপন পদ্ধতি, জীবিকার ধরন, তার হাঁড়ি-পাতিল থেকে আরম্ভ করে খাবার ও খাবারগ্রহণ পদ্ধতি, সবই সংস্কৃতি। গরুর গাড়ি, পালকি, নৌকা প্রভৃতি যানবাহন বাঙালির সংস্কৃতি। একতারা-দোতারা, ঢাকঢোল, জারিসারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি সংস্কৃতি। পুঁথি থেকে সাহিত্য, সংগীত, ভাস্কর্য, নৃত্যকলা সংস্কৃতি। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-বিশ্বাস সবই সংস্কৃতি; ভাষা সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বাইরে কিছু নেই। নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মতো সাংস্কৃতিক উপাদানের বিশিষ্টতা বাঙালি জাতিকে অপরাপর জাতিগোষ্ঠী থেকে পৃথক করেছে। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় আর্যদের থেকে যেমন আলাদা ছিল, তেমনি কিছুটা মিল থাকলেও ভারতীয় অন্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তা অভিন্ন নয়। তবে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি একবিংশ শতকে এসে বাকপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

সংস্কৃতির উদ্ভব প্রয়োজন থেকে। শিকার কিংবা উৎপাদনের জন্য যেমন হাতিয়ার তৈরি করতে হয়েছে, তেমনি কাজকে সহজতর করতে তৈরি হয়েছে সংগীত বা বসবাসকে নিরাপদ করতে কোনো আসবাব। যা ছিল জীবনযাপনসংশ্লিষ্ট তা-ই পরবর্তীতে নান্দনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিল্পরূপ লাভ করেছে। বাঙালির কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদনের হাতিয়ার বিশ্বায়নের যন্ত্রযুগে টিকে থাকার ঝুঁকির মধ্যে আছে। কুমারের মাটির শিল্পও সংকটাপন্ন।

ভাবপ্রবণ বাঙালির সবচেয়ে পরিচিত বাদ্যযন্ত্র একতারার সুর আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের উচ্চৈঃস্বরের কাছে ক্ষীণতর শোনায়। পুঁথি সাহিত্য প্রায় হারিয়ে গেছে। তাবিজ-কবচ-মাদুলি কি আছে এখনো? কিংবা জাদুটোনা, বাণউচাটন, ঝাড়ফুঁক? কলেরা-বসন্তের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার অশুভ প্রভাব? মেঘরাজার গানের মতো জাদুবিশ্বাস? কোনো কোনো অঞ্চলে এখনো এর প্রচলন বা প্রভাব হয়তো আছে। অতীতের ‘জৌলুস’হারিয়ে ফেললেও এর সবই আমাদের সংস্কৃতি।

প্রতিটি সাংস্কৃতিক উপকরণের মধ্যে এর টিকে থাকার শক্তি বিদ্যমান। যার অভিযোজন ক্ষমতা যত প্রবল তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। শীতলপাটি, বেতের আসবাব কিংবা নকশি কাঁথা টিকে থাকবে কি না, তা নির্ভর করে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতায় তার অবস্থানের ওপর। সাংস্কৃতিক উপকরণের স্থায়িত্ব ক্ষমতা মূলত, সংস্কৃতি-স্রষ্টার সৃজনী শক্তির ওপর নির্ভরশীল। পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে যদি যুগোপযোগী হয়ে বা করে সাংস্কৃতিক উপাদান তৈরি না হয়, তবে এর বিলুপ্তির ঝুঁকি বাড়ে।

বাঙালি জাতিসত্তার সবচেয়ে শক্তিশালী দিকটি হলো এর স্বীকরণের ক্ষমতা। সাংখ্য-যোগ, তন্ত্র ধর্ম-দর্শনে বিশ্বাসী জাতি বহিরাগত যখন যে ধর্ম-তত্ত্ব পেয়েছে, তা নিজের মতো করে গ্রহণ করেছে। এ জন্যই বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ও ইসলাম ধর্ম এখানে এসে লোকায়ত রূপ ধারণ করেছে। বাঙালির গ্রহণ করার ক্ষমতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তার সাহিত্য। বাঙালি ইউরোপীয় সাহিত্যরীতি গ্রহণ করেছে, তবে তাতে নিজস্ব জীবনানুভূতি ও জীবন দর্শনকে সাহিত্যরূপ দিয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে বিকশিত রূপটি সাহিত্য।

বাংলা ভাষাও প্রাচীন যুগের অস্পষ্ট, ভঙ্গুর গঠন পরিবর্তন করে পরিশীলিত আকৃতি ধারণ করেছে। কিন্তু নিম্নবিত্তের যে মানুষরা সমাজ-ধর্ম দ্বারা অবহেলিত অস্পৃশ্য, তার পেশা, বিশ্বাস, জীবনাচরণ হাজার বছর ধরে প্রায় সংস্কারহীন। পহেলা বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতি বলে যা উদযাপন করি তা রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে দারিদ্র্যপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর জীবনাচার। যা থেকে শিক্ষিত বিত্তবান শ্রেণি অনেক আগেই দূরে সরে এসেছে। আমরা লোকায়ত মানুষের শিল্পসৃষ্টিতে আপ্লুত হই, তার জীবনসংগ্রাম আমাদের ভাবায় কি?

গৃহকোণ থেকে ফসলের মাঠ, নদীনালা-পথপ্রান্তর থেকে শিল্পকারখানাÑসর্বত্র যন্ত্রসভ্যতার আধিপত্য। আমাদের হাতের মুঠোয় বিশ্ব। বিশ্বায়ন ও আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাবের এ যুগে চিরায়ত বাঙালি-সংস্কৃতির অনেক উপাদান হয়তো ঝুঁকির মধ্যে আছে। তবে সংস্কৃতির নতুন সৃজন ঐতিহ্যবিলুপ্তির অভাব পূরণ করতে পারে। সংস্কৃতির সংস্কার সাধন বা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি এবং শিক্ষা ও চর্চা।

যে সংস্কৃতি প্রগতির পথে বাধা প্রদান করে তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসে। একসময় সে বাঁধন ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে, যা ছিল প্রাত্যহিক কর্ম ও বিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তার সঙ্গে তৈরি হয় অপরিচয়ের দূরত্ব। নতুন সাংস্কৃতিক উপাদান এসে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির স্থান অধিকার করে। আমাদের আবহমান মুক্তির সংস্কৃতিকে ধারণ করেই বাইরের আলো গ্রহণ করতে হবে। তাতে অশুভ, অকল্যাণকর, অমানবিক কিছু যদি হারিয়ে যায়, তবে তার জন্য শোক করা যায় না।