রমজান শেষে আগমন ঘটে শাওয়াল মাসের। দীর্ঘ এক মাস রোযা, নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দো‘আ, ইবাদত-বন্দেগি ও তাকওয়ার চর্চা শেষে যখন মুসলিম জাতি ঈদের আনন্দে আত্মহারা হয়, তখনই সামনে আসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন,এই আত্মগঠনের ধারাটি কি রমজানেই শেষ? নাকি শাওয়াল মাস থেকেই শুরু হয় নতুন এক রূহানী অভিযাত্রা? শাওয়াল হলো তাকওয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষার মাস। এটি কেবল ঈদের আনন্দে মত্ত হওয়ার সময় নয়, বরং রমজানের অর্জনগুলো ধরে রাখার , সেগুলোকে সারা বছরের জীবনে বাস্তবায়নের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচনা।
শাওয়াল: রমজানের পূর্ণতার দরজা
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন: তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো, যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়। (সূরা আল-হিজর: ৯৯) এই আয়াত আমাদের শেখায় ইবাদত ও তাকওয়া কোনো ঋতুভিত্তিক কাজ নয়। রমজানে যে ইবাদতের চর্চা শুরু হয়, শাওয়াল সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার এক সোনালি সুযোগ।
শাওয়ালের ছয় রোজা: তাকওয়ার বাস্তব প্রশিক্ষণ
নবী করীম ﷺ বলেন: যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোযা রাখল, এরপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন পুরো বছরের রোযা রাখল। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৪) এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, শাওয়ালের ছয় রোযা শুধু নফল নয়, বরং এটি রমজানের ইবাদতের প্রতি একটি গ্রহণযোগ্যতা ও পূর্ণতার নিদর্শন। এটি তাকওয়ার অনুশীলনে নতুন উদ্দীপনা যোগায়।
তাকওয়ার ধারাবাহিকতা: ঈদের পরে এক চ্যালেঞ্জ
রমজানে অনেকেই রাত জেগে তাহাজ্জুদের অভ্যাস গড়ে তোলেন, কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়, দান-সাদকার হাত প্রশস্ত হয়। কিন্তু শাওয়ালেই তা সব যেন হারিয়ে না যায়। কুরআন বলে: যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, অতঃপর তারা অবিচল থাকে… (সূরা ফুসসিলাত: ৩০) এখানে আয়াতে ‘ইস্তাক্বামু’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ—অবিচল থাকা। রমজানের পরে সেই অবিচলতা রক্ষা করাই মূল তাকওয়া।
শাওয়াল: জীবনের নবউদ্দীপনা
রমজানের ইবাদত ছিল আত্মার এক মহাপুনর্বাসন। শাওয়াল মাস সেই নবজীবনের সূচনালগ্ন। শাওয়ালের প্রথম দিনই ঈদ, যেন এক বিজয় উৎসব। এই বিজয় শুধুই ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয়ের নয়, এটি নফসের বিরুদ্ধে এক আত্মিক জয়ের ইশারা। শাওয়াল মাস যেন বলে—হে মুসলিম! রমজানের মতো সারা বছর তাকওয়াপূর্ণ জীবন যাপন করো। রোজার পর এখন কাজের মাঠে নামো। পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র সর্বত্র আল্লাহভীরুতার দ্যুতি ছড়িয়ে দাও।
শাওয়াল মাসে বিয়েশাদি: সুন্নাতি সৌন্দর্য ও বরকতের বারতা
ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও সুন্নত। আর এই সুন্নাতি আমলকে এমন মাসে সম্পাদন করা যদি হয়, যে মাসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বিয়েশাদি করেছেন, তবে তা নিঃসন্দেহে আরও বেশি বরকতময় ও অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ ﷺ আমার সঙ্গে শাওয়াল মাসেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন , শাওয়াল মাসেই আমার সঙ্গে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। (সহীহ মুসলিম: হাদীস ৩৩৫২) এই হাদীসের ভিত্তিতে ফুকাহায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন যে, শাওয়াল মাসে বিয়েশাদি করা সুন্নতের অন্যতম নিদর্শন।
শুধু তাই নয়, আরও কিছু বরকতময় দিক এতে যুক্ত হয়
আয়েশা (রা.)-এর বিয়ে যেমন শাওয়াল মাসে সম্পন্ন হয়েছিল, তেমনই তা জুমার দিনে ও মসজিদে নববিতে সংঘটিত হয়েছিল। একই মাসে নবী করীম ﷺ আরও দুই সম্মানিতা সাহাবিয়া উম্মে সালামা (রা.) , সাওদা বিনতে যামআ (রা.)-এর সঙ্গেও বিবাহ সম্পাদন করেছেন। (সহীহ মুসলিম: হাদীস ১৪২৩) এসব থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, শাওয়াল মাসে বিয়েশাদি করায় রয়েছে এক বিশেষ ফজিলত ও বরকত।
শাওয়াল মাসের কিছু করণীয়
১. শাওয়ালের ছয় রোজা রাখা
২. ঈদের আনন্দে গাফেল না হয়ে ইবাদতের অভ্যাস বজায় রাখা
৩. কোরআনের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখা
৪. সদকা ও দান করার অভ্যাস চালু রাখা
৫. তাকওয়ার উপর ভিত্তি করে জীবনের নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা
শাওয়াল শুধু একটি মাস নয়, এটি একটি আহ্বান—রমজানের প্রাপ্তিকে ধরে রাখার, তাকওয়ায় অবিচল থাকার, , নতুন উদ্দীপনায় জীবনকে গড়ে তোলার। রমজানের মতো শাওয়ালও আমাদের একটি বার্তা দেয়,তাকওয়া হোক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেই মুসলিম সমাজ হতে পারে আলোকিত, ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে প্রকৃত মুত্তাকি।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুস সুন্নাহ মাদরাসা মাতুয়াইল, ডেমরা,ঢাকা