জান্নাতি যুবকদের সর্দার হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.)। তাঁর ব্যক্তিত্ব, জীবনাচার ও ত্যাগ-তিতিক্ষা ইতিহাসের বুকে চির অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবেন মুসলিম উম্মাহকে।
জন্ম ও পরিবার
হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) তৃতীয় হিজরির ১৫ রমজান (৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদিনের চতুর্থ খলিফা, সাহস ও জ্ঞানের প্রতীক হজরত আলী (রা.)। তাঁর মাতা ছিলেন জান্নাতের নারীদের সর্দার ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় কন্যা ফাতিমা (রা.)। জন্মের পরপরই তাঁকে মহানবী (সা.) কোলে তুলে নেন, আদর-স্নেহে ভরিয়ে দেন, তাঁর নাম রাখেন হাসান, যার অর্থ সুন্দর বা উৎকৃষ্ট।
নবী (সা.)-এর ভালোবাসা ও দোয়া
হজরত হাসান (রা.)-এর প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছিল অপার ভালোবাসা। তিনি প্রায়ই তাঁকে বুকে টেনে নিতেন, চুম্বন করতেন , বলতেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি উহিব্বুহু, ফাহবিবহু অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি, আপনিও তাকে ভালোবাসুন। (সহিহ বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, হাসান ও হুসাইন জান্নাতের যুবকদের নেতা। (তিরমিজি)
এই মহান দোয়া ও প্রশংসার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁর এই দুই নাতি কেবল রক্তের সম্পর্কেই নয়, বরং চরিত্র, নৈতিকতা ও আল্লাহভীতিতেও অনন্য হবেন।
শৈশব ও শিক্ষা
হাসান ইবনে আলী (রা.) পবিত্র নবুয়তি পরিবেশে লালিত-পালিত হন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহচর্যে বেড়ে ওঠেন , ইসলামি শিক্ষার সেরা আদর্শগুলোর সংস্পর্শ লাভ করেন। তাঁর পিতা হজরত আলী (রা.) ছিলেন জ্ঞানের ভাণ্ডার, , তাঁর মা ফাতিমা (রা.) ছিলেন তাকওয়া ও পরহেজগারির মূর্তপ্রতীক। এ কারণেই ছোটবেলা থেকেই তিনি এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের অধিকারী হয়ে ওঠেন,অমায়িক ব্যবহার, বিনয়, দানশীলতা ও ধৈর্য ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য।
গঠন ও অবয়ব
হজরত হাসান (রা.) দেখতে নবীজির (সা.) মতোই ছিলেন। অনেক সাহাবি বলেছেন যে, তাঁর মুখাবয়ব, চলাফেরা, কথা বলার ধরন নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে অনেকটাই মিল ছিল। তিনি সুউচ্চ, সুদর্শন, মৃদুভাষী , ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।
ইসলামের পথে আত্মনিয়োগ
হাসান ইবনে আলী (রা.) ইসলামের পথে সারাজীবন অতিবাহিত করেন। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে ইলম ও বিচক্ষণতার শিক্ষা গ্রহণ করেন, সাহাবিদের কাছ থেকেও ইসলামের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। নবীজি (সা.)-এর ওফাতের পর তিনি তাঁর পিতার সাথে ইসলামের খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন, সত্য-ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবিচল ছিলেন।
ইতিহাসে তাঁর ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে হজরত হাসান (রা.)-এর অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষত,যখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে লাগলো, তখন রক্তপাত এড়াতে নিজে খিলাফত ত্যাগ করে মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা ইতিহাসে ‘সুলহে হাসান’ নামে পরিচিত, যা মুসলিম ঐক্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, আমার এই নাতি (হাসান) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। (সহিহ বুখারি)
হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) ছিলেন ইসলামের এক অনন্য নক্ষত্র, যিনি প্রজ্ঞা, ধৈর্য, ত্যাগ ও ভালোবাসার এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর জীবন মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার অফুরন্ত খনি। তাঁর জন্ম এক বরকতময় ঘটনা, যা নবুয়তের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে আজও মানবজাতির হৃদয়ে আলো ছড়ায়। তাঁর চরিত্র ও আদর্শ আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারলেই প্রকৃত মুসলমান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।