ইতিহাসের পাতায় ২০ রমজান এক অবিস্মরণীয় দিন, এই ইসলামের বিজয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। ৮ হিজরি, ১০ জানুয়ারি ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), তাঁর সাহাবায়ে কেরাম মক্কার পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করেন, যা পরবর্তী সময়ে ইসলামের এক গৌরবময় অধ্যায়ে পরিণত হয়।
মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষাপট
আরবের কেন্দ্রস্থল মক্কা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামের বিরোধিতার প্রধান ঘাঁটি ছিল। নবুওয়তের প্রথম থেকেই কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি চরম শত্রুতার আচরণ করে আসছিল। তারা তাঁকে, তাঁর সাহাবীদের অকথ্য নির্যাতন করেছিল। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পরও কুরাইশরা তাদের শত্রুতার ছাড়েনি।
৬ হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদের নিয়ে উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওনা দেন। কুরাইশরা বাধা দেয়, যার ফলে হুদাইবিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে উভয় পক্ষ ১০ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। চুক্তির মাত্র দুই বছর পর কুরাইশরা তাদের মিত্র বনি বকর গোত্রকে দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মিত্র বনি খুজাআ গোত্রের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন নিরীহ লোক নিহত হন। কুরাইশদের এ বিশ্বাসঘাতকতার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।
মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি
রাসুলুল্লাহ (সা.) কৌশলগত কারণে তাঁর পরিকল্পনা গোপন রাখেন। তিনি ১০ হাজার সাহাবিকে নিয়ে মদিনা থেকে মক্কার দিকে যাত্রা করেন। বিশাল এ সেনাবাহিনী একত্রিত হয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেনাবাহিনীর প্রতিটি দলকে নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন, যেন কোনো রক্তপাত না ঘটে।
২০ রমজান, ৮ হিজরি, ভোররাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) চার দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি ঘোষণা করেন—
যে ব্যক্তি কাবা শরিফে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ; যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে থাকবে, সে নিরাপদ; যে ব্যক্তি নিজের গৃহে অবস্থান করবে, সে নিরাপদ। (সীরাত ইবনে হিশাম)
কুরাইশরা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) কাবা শরিফে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি কাবার চারপাশে থাকা ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ করেন, উচ্চারণ করেন:সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলীন হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা ধ্বংস হওয়ার জন্যই। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত : ৮১)
এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরাইশদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন—
হে কুরাইশবাসী! আজ তোমাদের কী মনে হচ্ছে, আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব? তারা উত্তর দিল, আপনি মহানুভব ও দয়ালু ভাই , দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করলেন: আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। তোমরা সবাই মুক্ত। (সীরাত ইবনে হিশাম)
মক্কার শুদ্ধকরণ ও ইসলামের বিস্তার
মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম তার শত্রুদের শিকল ভেঙে ফেলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) কাবা শরিফকে শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত করেন। তিনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার করেন, যা অল্প সময়ের মধ্যেই মক্কাবাসীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
মক্কার প্রধান নেতারা আবু সুফিয়ান, হিন্দা বিনতে উতবা, ইকরিমা বিন আবু জাহলসহ অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাদের পূর্বের শত্রুতার পরিবর্তে ইসলামের আলো তাদের হৃদয় আলোকিত করে।
ফলাফল ও ইসলামের বিস্তার
মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক মহান পরিবর্তনের সূচনা। এটি প্রমাণ করে যে ইসলাম যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, বরং ন্যায়বিচার, দয়া ও ক্ষমার মাধ্যমে বিজয় লাভ করে। মক্কা বিজয়ের পর গোটা আরবে ইসলামের বিস্তার ত্বরান্বিত হয়। একের পর এক গোত্র ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সমগ্র আরব উপদ্বীপ ইসলামের পতাকাতলে একীভূত হয়।
মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের শান্তিপূর্ণ বিজয়ের এক অনন্য নিদর্শন। এতে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি, বরং ক্ষমা, উদারতা ও শান্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি কেবল এক নগরীর বিজয় ছিল না, বরং এটি ছিল হৃদয়ের, ন্যায়বিচারের ও সত্যের বিজয়। মক্কা বিজয়ের শিক্ষা আমাদের আজও পথ দেখায়—ন্যায়পরায়ণতা, সহনশীলতা ও ক্ষমার মাধ্যমে প্রকৃত বিজয় অর্জিত হয়।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুস সুন্নাহ মাদরাসা মাতুয়াইল, ডেমরা, ঢাকা