আদালতের নির্দেশে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের পরিবারের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এসব সম্পদ চলে গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিয়ন্ত্রণে।
দুদক সূত্র বলেছে, পরবর্তী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জব্দ করা সম্পদ তত্ত্বাবধান ও দেখভালের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, একজন সরকারি চাকরিজীবী তার চাকরির মাধ্যমে এত সম্পদ উপার্জন করতে পারেন না। দোষী সাব্যস্ত হলে বিভিন্ন আইনে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড হবে সদ্যঃসাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের। একই সঙ্গে তার সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সত্যতা মিলেছে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, পরবর্তী নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা আপিল বিভাগে বহাল থাকবে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, সাবেক আইজিপির জব্দ ও অবরুদ্ধ হওয়া সম্পদের সামগ্রিক তদারকি করবে দুদক। তিন সদস্যের যে তদন্ত কমিটি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছে, তারা একটি কমিটি গঠন করে দেবে। দুদক চাইলে যেসব জেলায় কার্যালয় নেই, সেখানে জেলা প্রশাসনকে দেখভালের দায়িত্ব দিতে পারে।
আর অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাবগুলো থাকবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণে।
এ কর্মকর্তা জানান, আদালতের আদেশের পর এসব সম্পদ আর বেনজীর আহমেদের দখলে থাকার সুযোগ নেই। এখন এগুলো দুদকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দুদক শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করে রিসিভার নিয়োগ দেবে। তবে কমিশন যে কমিটি গঠন করবে তা আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।
রিসিভার কমিটিতে দুদক কর্মকর্তা, কিংবা জেলা প্রশাসন বা যেকোনো নিরপেক্ষ সংস্থা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সব সম্পত্তিতে আদালতের আদেশের সাইনবোর্ড টাঙানো হবে। পাশাপাশি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুলিপি পাঠানো হবে।
আদালতের আদেশের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা, তিন মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে থাকা ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। এসব দলিলে মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৪৬.৩০ বিঘা। যার দলিলমূল্য ১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব জমির দাম কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি বলে জানা গেছে।
এছাড়া তাদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে সাধারণ হিসাব, সঞ্চয়পত্র, ক্রেডিট কার্ডসহ ৩৩টি হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত। তবে এসব ব্যাংক হিসাবে কী পরিমাণ অর্থ সংরক্ষিত আছে তা জানা যায়নি।
আদেশে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংক হিসাব থেকে কোনোভাবেই টাকা উত্তোলন করা যাবে না। দুদকের বিধিমতে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের অধীনে বেনজীরের হিসাবগুলো অবরুদ্ধ থাকবে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে যেসব অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, তা বিক্রি ও হস্তান্তরের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের চেষ্টা করছেন বলে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। অনুসন্ধান বা মামলা নিষ্পত্তির আগে বর্ণিত সম্পত্তি হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শুনানিতে তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ নামে, স্ত্রী ও মেয়েদের নামে দেশে-বিদেশে শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন।
পরে এ বিষয়ে আদেশ দেন আদালত। আদেশে বিচারক বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তার আবেদন ও অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় আর্জি মঞ্জুরযোগ্য মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। বর্ণিত স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক (জব্দ) ও অস্থাবর সম্পত্তি ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করা না হলে তা হস্তান্তর হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না।
এদিকে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদের সম্পদ জব্দের আদেশ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন, দুদক স্বাধীন। সেখানে যদি কেউ অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হন, আমরা তাকে প্রটেকশন দিতে যাব কেন? তিনি সাবেক আইজিপি হোন আর সাবেক সেনাপ্রধান হোন। ’
গত ৩১ মার্চ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১’। এই পর্বে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে মূল প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জে বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ৬০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত চোখধাঁধানো রিসোর্ট। তার পাশে কিনেছেন আরও ৮০০ বিঘা জমি। শুধু তাই নয়, রাজধানী ঢাকার গুলশানে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটসহ দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি। হিসাব করে দেখা যায়, ৩৪ বছর সাত মাসের চাকরিজীবনে তিনি বেতন-ভাতা বাবদ আয় করেছেন এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা। ফলে তার এই বিপুল সম্পদের বৈধ উৎস নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
এছাড়া গত ২ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-২’। এ পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’। অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়। এতে বনের জমিই রয়েছে অন্তত ২০ বিঘা। ওই রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীরের পরিবারের হাতে।
গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলে। পরে গত ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। একই দিন বেনজীরের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকে আবেদন করেন সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
গত ২২ এপ্রিল তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির সদস্যরা হলেন কমিশনের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও নিয়ামুল হাসান গাজী। ২৩ এপ্রিল হাইকোর্টের এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন হলফনামা আকারে জমা দিতে বলা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনুসন্ধান কমিটির এক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তারা অনুসন্ধান শুরু করেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেনজীর ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান এখনো চলমান রয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও তথ্য পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।