২০২৪ সালের জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোতে ফরিদপুর যেন হয়ে উঠেছিল এক বিদ্রোহের নগরী। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারীরা শুধু অংশগ্রহণই করেননি— তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, সামনে দাঁড়িয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে। শুধু নারীরাই নয় এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন আবালবৃদ্ধবনিতা।
ফরিদপুরে এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১০ জুলাই দেশব্যাপী বাংলা অবরোধ কর্মসূচিকে সামনে রেখে। কোটা সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল ও সরকারি সব পর্যায়ের চাকরিতে কোটার সংস্কার দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করা হয় ফরিদপুরে। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ছাত্র ও ছাত্রীরা দাবির সমর্থনে একটি মিছিল বের করে। মিছিলকারীরা শহরের সুপার মার্কেটের সামনে সড়কে বসে চার রাস্তার মোড় অবরোধ করে। এদিন পুলিশ ছিল শান্ত, নিরব। গরমে গেমে নেয়ে ওঠা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সেভেন আপ পান করান ফরিদপুর কোতয়ালী থানার ওসি মো. হাসানুজ্জামান। এর ঠিক ২৬ দিন পর ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে কোতয়ালী থানার সামনে নিহত হন সামসু মোল্লা (৫৯)। এ আন্দোলনে ফরিদপুর পুলিশের গুলিতে শহরে তিনিই একমাত্র শহীদ।
পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের হামলা
১৬ জুলাই সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। ফরিদপুর শহরের ব্রাহ্মসমাজ সড়কে ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কার হোক। আন্দোলনের আয়োজন করেছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফরিদপুর’।
পুলিশ আন্দোলনের স্থান নির্ধারণ করে দিলেও আন্দোলনের সুর ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল। ঠিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যখন মিছিলের স্লোগান জোরালো হচ্ছিল, তখন হঠাৎ ঘটনাস্থলের দিকে আসে মোটরসাইকেলে ৫০-৫৫ জনের একটি দল। তারা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। দলের নেতৃত্বে ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত বিশ্বাস। পুলিশের সামনে দিয়েই তারা এগিয়ে আসে, মুখে কালো কাপড়, মাথায় হেলমেট, হাতে লাঠিসোঁটা।
তারা দৌড়ে এসে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠিপেটা শুরু হয়। ছয়জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। অথচ মাত্র ৫০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কোতোয়ালি থানার ওসি মো. হাসানুজ্জামান এবং উপস্থিত ২৫ জন পুলিশ সদস্য কেউই হামলাকারীদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেননি।
নারীরা নামেন প্রতিরোধে
১৮ জুলাই, নারীরা আবারও রাস্তায় নামেন। এদিন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে, স্টেশন রোড ও মুজিব সড়ক এলাকার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও যুবলীগ সদস্যরা সেদিনও আন্দোলনকারীদের পেটান। এদিন নারীসহ অনেকেই আহত হন। কিন্তু নারীরা পিছু হঠেননি। বরং তারা সিদ্ধান্ত নেন— এবার রক্তের বদলা নিতে হবে সাহসে।
৩১ জুলাইয়ের নারীমিছিল, সাহসের দৃশ্যপট
ফরিদপুরে এই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ৩১ জুলাই। সকাল থেকেই শহরের গোয়ালচামট এলাকায় নারীরা জড়ো হতে থাকেন। বেশিরভাগই স্কুল ও কলেজের ছাত্রী। সাদা পোশাক, আবার কেউ কেউ স্কুল কলেজের ড্রেস পরে। হাতে পোস্টারে লেখাছিল- ‘রক্তের দাগ শুকায় নাই, ‘জেলখানা আরও বাড়ান সাহেব, আসছে ফাগুন, আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবেই বাংলাদেশ’। আর ফেস্টুনে ছিল শহীদ আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাতের ছবি— তার নিচে লেখা, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দখলে নেয় এই নারীদের মিছিল। তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মানুষ থমকে তাকিয়ে থাকে এই দৃশ্যপটে।
৩ আগস্টেই ফরিদপুর দখল নেয় ছাত্রজনতা
৩ আগস্ট আবারও উত্তাল হয় ফরিদপুর। সকাল ১১টার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে বিশাল মিছিল বের হয়। এতে ফরিদপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও যুক্ত হন। সামনে ছিলেন নারীরা।
মিছিল যখন ভাঙ্গা রাস্তার মোড়ের দিকে এগোচ্ছে, পুলিশ তখন প্রস্তুত— সাঁজোয়া যান, হেলমেট, অস্ত্রসহ অবস্থান নেয় তারা। তাদের সঙ্গে ছিলেন শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নেতৃত্বে ছিলেন শ্রমিকলীগের সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ নাসির,স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রবিন এবং ছাত্রলীগ নেতা দেবাশীষ বিশ্বাস নয়ন।
মিছিলটি ভাঙ্গা রাস্তার মোড় এলাকায় পৌঁছানোর আগেই হামলা হয়। পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ে, টিয়ারশেল ফাটায়, সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। তবে চিত্র পাল্টে যায় যখন আশপাশের দোকানপাট থেকে সাধারণ মানুষ, এমনকি ৭০ বছরের এক বৃদ্ধাও এসে বলেন, ‘তোরা মার ওগো (ছাত্রলীগের নেতাদের)। আমি মরি সমস্যা নাই।’ তিনি ছাত্রদের হাতে ইট তুলে দেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা দৌড়ে পালিয়ে যান। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলের মধ্যেও নারীরা ভেঙে পড়েননি।
রক্তাক্ত নারী শিক্ষার্থী, ভাইরাল প্রতিচ্ছবি
ফরিদপুর পুলিশ লাইনস স্কুলের এক ছাত্রীর মাথা ফেটে যায় শ্রমিক লীগের লাঠি পেটায়। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রীর রক্তাক্ত মাথা, মুখ গুজে থাকা ছবি—এই প্রতিচ্ছবি ফরিদপুরের জনতাকে নাড়িয়ে দেয়।
আটকের রাত ও সাহসের সকাল
৩ আগস্টেই ফরিদপুর শহর থেকে শতাধিক শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। তাদের রাখা হয় পুলিশ লাইন্স স্কুলে। আটক করা হয় অনেক নারী শিক্ষার্থীকে। ভয়ের সেই রাতেও তারা সাহস হারাননি। পরদিন সকালেই আবারো গোয়ালচামটে নারীদের মিছিল দেখা যায়। সেই মিছিলে স্লোগান ছিল—‘ভয়ের ভিত গুঁড়িয়ে দেব’, ‘রক্ত দিয়ে হোক নতুন সকাল’।
ওই দিন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পুলিশ বক্স, জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় ছাত্র জনতা। কার্যত তখন মাঠ থেকে লেজ গুটিয়ে পালায় ছাত্রলীগ যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। ওই দিন নারীরা লাল রং দিয়ে নিজেদের গালে লিখেন- এক দফা স্বৈরাচার হাসিনার পতন চাই। ওইদিন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে থেকে এক ছাত্রলীগ নেতা ছাত্রজনতার বুকে গুলি চালায়।
ফরিদপুরে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন অনেক নারী। এদেরই একজন কাজী জেবা তাহসিন। তিনি সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ইসালামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছেন। তার বাড়ি শহরের পশ্চিম খাবাসপুর মহল্লা এলাকায়। ফরিদপুরের জুলাই আন্দোলনের বর্ণনা দেন এ নারী।
তিনি বলেন, ‘জুলাই মাসটা আমার কাছে শুধুই ক্যালেন্ডারের পাতা নয় এটা একটি যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি, আবার একই সঙ্গে এক অসীম সাহসের নাম। আমি নিজে একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হিসেবে সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা বয়ে চলেছি। আমার জীবনের অন্যতম বড় যে শিক্ষা আমি সেই জুলাইতেই পেয়েছি তা হলো- ভয় পেলে চলবে না, জেগে উঠতে হবে। নিজের অধিকারের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, যত বড় বিপদই আসুক না কেন।
১৮ জুলাই ডিসি অফিসের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান চলছিল। হঠাৎ করেই পুলিশ হামলা শুরু করে। কাউকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে, কেউ পালানোর চেষ্টা করলেও ধাওয়া করে ধরে ফেলে। যে পুলিশ জনগণের হওয়ার কথা সে পুলিশ স্বৈরাচার হাসিনার কথা মতো নিজের চাকরি বাঁচাতে কিভাবে ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ করে। কিছুক্ষণের ভেতর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এসে হামলায় অংশ নেয়। এক ছোট বোনের মাথা পেটে যায়, কত ভাইদের পশুর মতো লাঠির আঘাত করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এক আপুকে যুবলীগের এক সদস্য পেটে আঘাত করে—তিনি ছিলেন গর্ভবতী। অজানা সেই শিশুটি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই হারিয়ে যায়। ডিসি কামরুল হাসান তালুকদার ডিসি অফিসের ছাদ থেকে সবকিছু দেখছিলেন। তিনি ছিলেন নীরব দর্শক, যেন একটি নিষ্ঠুর তামাশা দেখছিলেন। ওই দিন আমি এবং আরও অনেকেই ডিসি অফিসের বিপরীত পাশে প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে ছিলাম। সেদিন রাতে আমাকে ফোন দিয়ে একজন হুমকি দেই আমি যদি বাসা থেকে বের হয় তাহলে আমার ও আমার পরিবারের ক্ষতি হবে। কিন্তু আমি থেমে থাকি নি, আমি আন্দোলন চালিয়ে যাই।
৩ আগস্ট সকালে ভাঙা রাস্তার মোড় থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ হামলার জন্য এগিয়ে আসে তখন ছাত্রদের সঙ্গে তাদের একটা সংঘর্ষ হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। ছাত্রলীগের নেতারা আমাদের ধাওয়া করে। ওইদিনও আমি একটি বাসায় আটকে ছিলাম, বাইরে চলছিল ভয়াবহ উত্তেজনা। পুলিশের হামলার পর সবাই ছন্নছাড়া হয়ে গেলো অনেকে ভেবেছিলো আর ওইদিন আন্দোলন হবে না কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারও শুরু হলো শামসুল আলম মাদ্রাসার সামনে আন্দোলন। তখনও পুলিশের সাথে কত কথা কাটাকাটি। এরপরও আন্দোলন থেমে ছিলো না। সর্বশেষ মেডিকেলের সমানে গিয়ে আন্দোলন শেষ হয়।
৪ আগস্ট সকালে কল্পনাও করিনি ফরিদপুরে এত বড় আন্দোলন হবে। ওইদিন মেডিকেলের সামনে থেকে পুলিশ কাউকে একত্রিত হতে দিচ্ছিল না। সবাই ছন্নছাড়া ছিলাম। পরবর্তীতে একটা বড় মিছিল বের হলো তখন চাইলেও পুলিশের ছিলো না কিছু করার। সবাই একসাথে সংঘটিত হয়ে আন্দোলন শুরু করি। এরপর রাজেন্দ্র কলেজের ওইদিকে পুলিশরা দাঁড়িয়ে ছিল। পেছন থেকে পুলিশ টিয়ারগ্যাস মারে। চোখের সামনেই ছেলেমেয়েরা অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল, কেউ সামনে এগিয়ে আসছিল, কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছিল। টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় আমিও কিছু দেখছিলাম না। কিন্তু আফসোস এখনো এই সন্ত্রাসীদের কোন বিচার হয় নাই, বিচার হয় নাই সেইসব পুলিশ কর্মকর্তাদের যারা জুলাই আন্দোলনে আমাদের ভাইদের গুলি করে হত্যা করেছিল, গাড়ি চাপা দিছিল। বরং তারা বদলি হয়ে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। এরপর হয়তো কোনো আন্দোলন হলে কোনো মা তার সন্তানকে ছাড়বে, কোনো মা বলবে না তার সন্তান কে রাজপথে নামতে। কারণ এদেশে অপরাধীর কোনো বিচার নেই। অপরাধীরা অন্যদের শেল্টার নিয়ে নিরাপদে আছে।
আমি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, যেখানে কোনো মায়ের কোলে সন্তান হারানোর বেদনা থাকবে না, কোনো বাবাকে থানার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে না “আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন”। আমি যে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছিলাম, সেটা ছিল সত্য ও ন্যায়ের ওপর দাঁড়ানো একটি মানবিক রাষ্ট্র। যেখানে কেউ গুম হবে না, কেউ ‘ভিন্নমত’ প্রকাশের কারণে লাশ হয়ে ফিরবে না। যেখানে শিক্ষাঙ্গন হবে মুক্তচিন্তার জায়গা, রাজনীতি হবে দেশের উন্নয়ন ও নৈতিকতার জায়গা, আর মানুষ হবে মানুষের জন্য।
আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সেই জুলাইয়ের দিনগুলোর কথা ভাবলে কষ্ট হয়। আসলে আমরা কি সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি? নাকি সময়ের স্রোতে আমরা আবারও পেছনে হাঁটছি? তবুও আমি আশাবাদী। কারণ আমি জানি, আবার একদিন কেউ না কেউ জেগে উঠবে, আবারও কেউ ‘না’ বলবে অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই দিন, সেই সকাল হয়তো বা খুব দূরে নয়।