ছেলেদের সংসারে অভাব, ভ্যানগাড়ি ঠেলে জীবন চলছে ৮০ বছরের চানমতীর
মানিকগঞ্জে ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছেন ৮০ বছর বয়সী চানমতী। তিনি মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেহেন্দীবাগ গ্রামের মৃত আফছের আলীর স্ত্রী। প্রায় ৪০ বছর আগে চানমতীর স্বামী আফছের আলী মারা গেছেন। এরপর সন্তানদের নিয়ে শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম। শুরুতেই অন্যের বাসাবাড়িতে করেছেন তিন। পরে বিভিন্ন জায়গায় মাটি কেটে সংসারের হাল ধরেছেন। তবে ছেলে-মেয়ে বড় হওয়ার পর পেশা বদলে দুই যুগ ধরে পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রি করছেন তিনি।
বাবার অভাবের সংসারে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় চানমতীর। দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও পিছু ছাড়েনি অভাব-অনটন। দিনমজুরের কাজ করে স্বামীর যা রোজগার হতো, তা দিয়ে কোনোমতে চলছিল সংসার। এরই মধ্যে দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় ৪০ বছর আগে স্বামী মারা যান। পরে চানমতী ছোট সন্তানদের নিয়ে এক অবর্ণনীয় কষ্টে পড়েন। খেয়ে না-খেয়ে দিন চলতে থাকে তার। অন্যের বাড়িতে কাজ করে ও মানুষের সহযোগিতায় চলতে থাকে দিন। তবে সংসারের চাহিদা অনুযায়ী উপার্জন না হওয়ায় হতাশায় ভেঙে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে তার মাথায় এল পাইকারি বাজার থেকে শাকসবজি কিনে জেলা শহরে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করবেন। এভাবেই প্রায় ২৫ বছর আগে শুরু করেছিলেন ফেরি করে সবজি বিক্রির কাজ। সন্তানরা থাকলেও এখনো নিজের খরচ জোগাতে এখনো ভ্যানগাড়িতে ফেরি করে সবজি বিক্রি করে যাচ্ছেন এই সংগ্রামী নারী।
চানমতীর দুই ছেলে। একজনের নামে মো. মিঠু । অপরজন রমজান আলী। মিঠু ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। বিয়ে করার পর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন। আর ছোট ছেলে রমজান ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে মেহেন্দীবাগ গ্রামে পৈতৃক বসতবাড়িতেই আছেন। চানমতীর মেয়ে শিরিন আক্তার বিয়ের পর থেকে স্বামীর বাড়িতে। মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার উত্তর সেওতা, গঙ্গাধরপট্টি ও পোড়রা এলাকায় দুই চাকার ভ্যানগাড়ি ঠেলে শাকসবজি বিক্রি করেন তিনি। দুই চাকার ভ্যানগাড়ি ঠেলছেন আর মাঝেমধ্যে হাকডাক ছেড়ে বলছেন, ‘সবজি লাগব… সবজি?’। মেহেন্দীবাগ গ্রামে স্বামীর ছয় শতক বসতভিটায় ছোট ছেলের সংসারে থাকেন চানমতী।
সেওতা এলাকার গৃহবধূ লিবিয়া খানম আল্পনা বলেন, বৃদ্ধা চানমতীর কাছ থেকে সবসময়ই আমি সবজি কিনি। তবে তিনি যে ভ্যানগাড়ি ঠেলে সবজি বিক্রি করে সেটিও ভাঙা আর তার পুঁজিও কম। কিন্তু এই বয়সে এসেও তিনি অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে কাজ করে খাচ্ছেন। সরকারি বা বেসরকারিভাবে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করলে ভালো হতো।
গঙ্গাধরপট্টি এলাকার বাসিন্দা মোশারফ হোসেন বলেন, চানমতী কঠোর পরিশ্রম করে ভ্যানগাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করেন। তার বয়সের অনেকেই আছে ভিক্ষাবৃত্তি করেন, কিন্তু তিনি সেটা না করে কর্ম করে খান। তবে বয়সের ভাড়ে এই কাজ করতে খুব কষ্টও হয়। চানমতী নিজেই একটি উদাহারণ যে, পরনির্ভরশীল বা ভিক্ষা না করে সবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সবজি বিক্রেতা বৃদ্ধা চানমতী বলেন, বিয়ের পর স্বামীর সংসারে যোগান দিতে ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করেছি। আর তার (স্বামী) মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে অভাবের সংসারের খরচ মেটাতে বাসাবাড়িতে কাজ করেছি, মাটি কেটেছি। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে সাদি দিয়েছি। তাদের সংসারের টানাটানি। এজন্য নিজের খরচ জোগার করতে এই বয়সেও এসেও ভ্যানগাড়িতে ফেরি করে সবজি বিক্রি করি।
তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো সবজি বিক্রি হয় না। আশপাশের অনেক বাজার হয়ে গেছে আবার অনেকেই ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে। বয়সের কারণে চলাফেরা করাও অনেক কষ্ট হয়। সারাদিন ফেরি করে যা বিক্রি করে তা দিয়ে কোনোমতো চলি। আগের মতো পরিশ্রম করতে পারি না, ভ্যানগাড়ি ঠেলতেও অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু কি করবো পেটে ক্ষুধা থাকলে তো কাজ করতেই হবে, ক্ষুধা মিটাতে হবে। দুই ছেলের সংসারের অভাব, তাদের চলতেই কষ্ট হয়। তারা (ছেলেরা) যতটুকু পারে আমাকে দেখে।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শেখ মেজবাহ উল সাবেরিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজে এখনো অনেক নারীই আছেন যারা সংগ্রাম করে জীবনযাপন করছেন। চানমতীর বিষয়ে জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে আলাপ করবো এবং খোজঁখবর নিয়ে তাকে সহযোগিতা করা হবে তিনি জানান।