রোজা এবং পরবর্তী সময়ে দেশে ফলের দাম স্থিতিশীল রাখতে চলতি মাসেই আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ তাজা এবং শুকনা ফল আমদানিতে উৎসে কর কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সে অনুযায়ী ফলের পাইকারি বাজারে আগের তুলনায় কিছুটা কম দামেই বিক্রি হচ্ছে আমদানিকৃত এসব ফল। তবে এর সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ক্রেতারা। ঘুরেফিরে বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে বাজারে প্রচলিত এই বিদেশি ফলগুলো।
খুচরা দোকানগুলোতে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ ফল বাদামতলীর পাইকারি বাজার থেকে সংগ্রহ করা হলেও কোনো জায়গাতেই দামের মিল নেই। বাজার বা এলাকার পরিবর্তনে দামও ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। বিক্রেতারা অনেকটা দাম চাইছেন নিজের খেয়ালখুশি মতো।
রাজধানীর বাদামতলী ফলের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার পাইকারি দোকানগুলোতে মিশর থেকে আমদানি করা ১৫ কেজি ওজনের মাল্টার ক্যারেট মানভেদে ৩৪০০-৩৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা কেজি হিসেবে দাম পড়ছে ২২৬-২৪০ টাকা। ২০ কেজি ওজনের লাল আপেলের ক্যারেট বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৫৪০০-৫৫০০ টাকা। যা কেজি হিসেবে দাম পড়ছে ২৭০-২৮০ টাকা। গুড ফার্মা কোম্পানির এ গ্রেডের ২০ কেজি ওজনের আপেলের ক্যারেট বিক্রি হচ্ছে ৬২০০ টাকায়। কেজি হিসেবে এর দাম পড়ছে ৩১০ টাকা। আবার, ২০ কেজি ওজনের সবুজ আপেলের ক্যারেট ৬৭০০ টাকা এবং গালা আপেলের ক্যারেট ৬৫০০ টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে। কেজি হিসেবে এর দাম পড়ছে যথাক্রমে ৩৩৫ টাকা এবং ৩২৫ টাকা। আর নাশপাতি ৯-১০ কেজি ওজনের নাশপাতির ক্যারেট মানভেদে ২৩০০-২৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজি হিসেবে যার দাম পড়ছে ২৩০-২৫০ টাকা।
অন্যদিকে, ৮ কেজি ওজনের কমলার ক্যারেট (৬০-৬৫ পিস) আকার ও মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৯০০-২৩০০ টাকায়। কেজি হিসেবে যার দাম পড়ছে ২৩৮-২৮৭ টাকা।
এছাড়া, ২০ কেজি ওজনের সাদা আঙুরের ক্যারেট মানভেদে ৫৪০০-৫৫০০ টাকা এবং ১০ কেজি ওজনের কালো আঙ্গুরের ক্যারেট মানভেদে ৩৭০০-৩৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজি হিসেবে যার দাম পড়ছে ২৭০-২৭৫ টাকা এবং ৩৭০-৩৮০ টাকা।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, দেশের এই বৃহত্তম পাইকারি ফলের বাজারের মাত্র ১ কিলোমিটার দূরের সদরঘাট এলাকার খুচরা বাজারেই পাইকারি দামের কাছাকাছি নেই এসব ফলের দাম।
সদরঘাট এলাকার এবং টার্মিনালের সামনের ফলের দোকানগুলোতে বি গ্রেডের লাল আপেল ৩০০-৩২০, এ গ্রেডের আপেল ৩২০-৩৫০ টাকা, সাদা আঙুর ৩১০-৩২০ টাকা, কালো আঙুর ৪০০-৪৫০ টাকা, নাশপাতি ২৮০-৩০০ টাকা, মাল্টা ২৮০-৩০০ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে।
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, আমরা সাধারণত স্বল্প লাভে অধিক পরিমাণে বিক্রি চেষ্টা করে থাকি। যত বেশি বিক্রি তত বেশি লাভ এই নীতি অবলম্বন করি। আর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পাইকারি দামের সঙ্গে খুচরা বিক্রেতারা ১৫ শতাংশ লাভ যোগ করে ফল বিক্রি করতে পারেন। তবে, অধিকাংশরাই এর বেশি লাভ করে থাকেন।
এরপর ৬ কিলোমিটার দূরত্বের গুলিস্তান এলাকার ফলের দোকানগুলোতেও একই অবস্থা দেখা গেছে। এখানকার খুচরা ফলের দোকানে আপেল ৩২০-৩৫০ টাকা, মাল্টা ২৮০-৩০০ টাকা, কমলা ৩২০-৩৩০ টাকা, সাদা আঙুর ৩৫০ টাকা এবং কালো আঙুর ৪৫০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি দাম দেখা গেছে বাদামতলী থেকে সাড়ে ৫ কিলোমিটার দূরত্বের নিউমার্কেট এলাকার ফলের দোকানগুলোতে। সেখানে খুচরা বাজারে লাল ও সবুজ আপেল যথাক্রমে ৩৫০ ও ৩৮০ টাকা, মাল্টা ৩০০-৩১০ টাকা, কমলা মানভেদে ৩০০-৩৩০ টাকা, সাদা আঙুর ৩৫০-৩৭০ টাকা এবং কালো আঙুর ৪৩০-৪৮০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
বাদামতলী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে মিরপুর মাটিকাটা এলাকার ফলের খুচরা দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে মান ও জাতভেদে আপেল ৩২০-৩৮০ টাকা, কমলা ৩২০-৩৫০ টাকা, সাদা আঙুর ৩২০-৩৩০ টাকা, কালো আঙুর মানভেদে ৫৩০-৫৫০ টাকা, মাল্টা ২৮০-২৯০ টাকা এবং নাশপাতি ৩৪০-৩৬০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। অর্থাৎ অধিকাংশ খুচরা বিক্রেতারা প্রায় ফলগুলোতেই সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কিংবা তার চেয়ে বেশি লাভ করছেন।
ফলের পাইকারি বাজার দর সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষেরই আইডিয়া নেই। তাই খুচরা বাজারে বিক্রেতারা যা বলেন সেই দামেই তারা কিনে নেন। এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় দাম অনেকটা কমেছে। রোজায় কোনো ফলের সংকট হয়নি। মার্কেটে প্রচলিত সব ধরনের ফলই রয়েছে। সে অনুযায়ী দামও কিছুটা কম থাকার কথা।
পাইকারি বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম
বাদামতলীর পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, আমরা সাধারণত স্বল্প লাভে অধিক পরিমাণে বিক্রি চেষ্টা করে থাকি। যত বেশি বিক্রি তত বেশি লাভ এই নীতি অবলম্বন করি। আর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পাইকারি দামের সঙ্গে খুচরা বিক্রেতারা ১৫ শতাংশ লাভ যোগ করে ফল বিক্রি করতে পারেন। তবে, অধিকাংশরাই এর বেশি লাভ করে থাকেন।
সাইফুল ইসলাম নামের এক পাইকারি বিক্রেতা বলেন, সকালে আরও কম দামে ফল বিক্রি হয়। ফলের পাইকারি বাজার দর সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষেরই আইডিয়া নেই। তাই খুচরা বাজারে বিক্রেতারা যা বলেন সেই দামেই তারা কিনে নেন। এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় দাম অনেকটা কমেছে। রোজায় কোনো ফলের সংকট হয়নি। মার্কেটে প্রচলিত সব ধরনের ফলই রয়েছে। সে অনুযায়ী দামও কিছুটা কম থাকার কথা।
আমরা পাইকারি বাজার থেকে কিছুটা কম দামে কিনে এনে খুচরা বাজারে বিক্রি করি। এখানে পরিবহন খরচ, দোকানের ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং অন্যান্য খরচ যোগ করার কারণে দাম বেড়ে যায়।
খুচরা ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের
রবিউল ইসলাম নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, বিভিন্ন ফলের পাইকারি বাজারে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কম থাকলেও খুচরা বাজারে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। মনে করেন, ১ কেজি আপেল পাইকারি বাজারে ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে নিয়ম অনুযায়ী, সেটি খুচরা বাজারে ১৫ শতাংশ বেশি ধরে ৯২ টাকা হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। খুচরা বিক্রেতারা নিজেদের মতো দাম নেন। দাম নির্ধারণে কোনো নিয়মনীতি বা মনিটরিং না থাকার কারণেই তারা এমনটি করার সুযোগ পান।
অন্যদিকে পাইকারি বাজারে কম দামের পরও খুচরা বাজারে দাম বাড়তি প্রসঙ্গে কিছু বিক্রেতা জানান, নানা কারণে তাদের ওপর বাড়তি চাপ থাকে। তাদের মতে, পরিবহন খরচ, দোকানের ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং অন্যান্য খরচের কারণে খুচরা বাজারে দাম কমানোর সুফল আসছে না।
আব্দুল কাদের নামের এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে কিছুটা কম দামে কিনে এনে খুচরা বাজারে বিক্রি করি। এখানে পরিবহন খরচ, দোকানের ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং অন্যান্য খরচ যোগ করার কারণে দাম বেড়ে যায়।
হাফিজুল্লাহ নামের আরেক খুচরা বিক্রেতা বলেন, পাইকারি বাজারে কম দাম হলেও আমরা খুচরা বাজারে দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছি। নানা খরচের কারণে আমরা ক্রেতাদের কাছে কম দামে দিতে পারি না। শুল্ক প্রত্যাহারের পর কিছু ফলের দাম কমেছে। তবে আমাদের পরিবহন খরচই অনেক পড়ে যায়। যার ফলে ক্রেতাদের কাছে কম দামে ফল পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
এমন অবস্থায় ক্রেতারা বলছেন, ফল বিক্রির বাজারে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। খুচরা বাজারে দাম নির্ধারণে একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। না হলে, ক্রেতাদের জন্য এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকবে।
বাদামতলী বাজারে ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খালিদ হাসান বলেন, রোজায় ইফতারের জন্য প্রায়ই ফল কেনা হয়, খুচরা বাজারে অনেক বেশি দাম দিয়ে আমরা ফল কিনি। আজ এই পাইকারি ফলের বাজার ঘুরে সেটি বুঝতে পারলাম। আসলে, খুচরা বাজারে এই ধরনের বিশৃঙ্খলা রোধ করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
নুরুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা বলেন, পাইকারি বাজারে দাম কমেছে এটা শুনেছি কিন্তু খুচরা বাজারে সেই সুফল দেখতে পাচ্ছি না। এক কেজি আপেল পাইকারিতে ৩২০ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। বলা যায়, দাম আগের মতোই। আমরা তো ভেবেছিলাম শুল্ক প্রত্যাহারের পর কিছু পরিবর্তন হবে। কিন্তু সেটা ফলের বাজারে পরিবর্তন হয়নি, বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে ফলগুলো।