রবিবার , ২৪শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ৯ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - শরৎকাল || ১লা রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

খরচের উত্তম খাত হোক মানবসেবা “দিদারুল ইসলাম

প্রকাশিত হয়েছে- সোমবার, ২২ মে, ২০২৩

 মোঃ দিদারুল ইসলাম, পথকলি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও নিউজ টিভি বাংলা ব্লাড ব্যাংকের সভাপতি 

আমরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করি যে মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু কেন মানুষ মানুষের জন্য? কারণ এই নীতিতে মানুষই মানুষের শক্তি জোগায় এবং ব্যাপারটি প্রকৃতিগতও বটে। প্রকৃতিতে দেখা যায় দাতা দান করে আরো শক্তি সঞ্চয় করে আর গ্রহীতা বেঁচে থাকে দাতার দানের গুণে। সূর্য ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূর থেকে পৃথিবীবাসীকে প্রতিনিয়ত আলো ও তাপ দান করে সজীব রাখছে। আকাশ থেকে বর্ষিত বৃষ্টির ফোঁটা কাজে লাগিয়ে গাছপালা সূর্যালোক ও প্রকৃতিতে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে ছেড়ে দেয়া কার্বন-ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে তার খাবার তৈরি করে অক্সিজেন ছেড়ে দিচ্ছে। সে অক্সিজেন ব্যবহার করে আমরা প্রাণীরা বেঁচে আছি। কিন্তু সূর্য এত যে দান করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে তাতে সূর্যের এতটুকু শক্তিও কমে যাচ্ছে না; বরং আরো শক্তি সঞ্চয় করে আরো দান করতে প্রস্তুত হচ্ছে।

মানুষের জন্য কিছু করে কেউ গরিব এবং অসম্মানিত হয়েছে এমন উদাহরণ দুনিয়াতে নেই; বরং এ ক্ষেত্রে তার উল্টোটাই সত্য। বিশ্বের ধনী বিল গেটস চলতি বছরের ১৩ জুলাই ঘোষণা করেছেন, তার দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন আরো দুই হাজার কোটি (২০ বিলিয়ন) ডলার অনুদান দেবেন। তিনি আরো সম্পদ দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় তিনি আর থাকতে চান না। বলেছেন, সমাজে তার সম্পদ দান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর আগে ২০১০ সালে বিল গেটস তার সব সম্পদ দান করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে তার সম্পদ দ্বিগুণ হয়েছে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তার সম্পদমূল্য ১১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সৌদি আরবের শিল্পোদ্যোক্তা ও বিলিয়নিয়ার শায়খ সোলায়মান বিন আবদুল আজিজ আল-রাজির সম্পদের পরিমাণ ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে ৫.৯ বিলিয়ন ডলার। তাকে বিশ্বের ১৬৯তম ধনী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। ২০১০ সালে তিনি তার বিশাল সম্পদের অর্ধেক ওয়াক্ফ করে দেন। সেই ওয়াক্ফ করা সম্পদের বর্তমান মূল্য ৬০ বিলিয়ন রিয়ালের বেশি। জানা গেছে, এত সম্পদ বিলি করার পর থেকে তার সম্পদের পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে গেছে।

মানুষ ও অন্যান্য অনেক প্রাণীই সামাজিক জীব। মানুষই একা চলতে পারে না। তাকে সবার সাথে মিলেমিশে চলতে হয়। যারা অঢেল অর্থসম্পদের মালিক, তারা যেমন অসহায় ও অসচ্ছলদের সহযোগিতা করে থাকেন, ঠিক এর উল্টো অসহায়দের সহযোগিতা ছাড়াও ধনীরা একটা দিন পার করতে পারেন না।

মানুষ নানাভাবে সুখ পেতে চায়। কিন্তু ভুল দর্শনে এই সুখের সন্ধান মানুষকে অন্ধ ও বোকা বানিয়ে ফেলতে পারে। কেউ হয়তো অবৈধ পথে অনেক অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে সাময়িক বাহ্যিক সুখ পেলেও তার এই সুখ তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। আর বৈধ পথে অপেক্ষাকৃত কম অর্থ-সম্পদ উপার্জন করে যখন মানবতার কল্যাণে তা ব্যয় করে তখন সে সুখ হয় অফুরন্ত। হজরত আলী রা:-এর একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘মানুষ বড়ই আশ্চর্যজনক ও বোকা। সে সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য হারায় তার পর আবার স্বাস্থ্য ফিরে পেতে সম্পদ নষ্ট করে। সে বর্তমানকে ধ্বংস করে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আবার ভবিষ্যতে কাঁদে অতীতের কথা স্মরণ করে। সে এমনভাবে জীবন অতিবাহিত করে যে সে কখনো মরবে না কিন্তু সে এমনভাবেই মরে যেন সে কখনো জন্মায়-ই নি।’

অন্যকে সহায়তা করা নিজের মর্যাদাকে জাগিয়ে তোলার একটি ভালো প্রচেষ্টা। তা ছাড়া নিজের জন্য মানুষের কাছে হাতপাতা লজ্জাজনক, অথচ দুস্থ মানুষের জন্য অন্যের কাছে হাতপাতা অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। ‘যে ব্যক্তি অন্যের কল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করে সে প্রকৃতপক্ষে নিজের কল্যাণই নিশ্চিত করে।’ (চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস)

যাদের অর্থ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেশি আছে তাদের জন্য উত্তম পলিসি হলো অধিকসংখ্যক সৎ ও যোগ্য সন্তান রেখে যাওয়া। সম্পদের পেছনে যত সময় আমরা দেই, তার চেয়ে বেশি সময় দেয়া উচিত সন্তান মানুষ করার পেছনে। সম্পদের ভালো একটি অংশ সন্তানকে সৎ ও যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে ব্যয় করা উচিত। নিজের মিনিমাম চাহিদা পূরণের পর প্রত্যেকেরই উচিত বাকি সম্পদ সদকায়ে জারিয়া হিসেবে দান করে যাওয়া। অসৎ সন্তান আর অবৈধ সম্পদ মূলত অবনতি আর অবক্ষয়ের উপকরণ। দান বা সহযোগিতার উত্তম খাত কোনটি?

রাসূল সা: বলেছেন, “দুটো জিনিস মানুষের উন্নতির উপকরণ। একটি ‘উত্তম সন্তান’, অন্যটি সাদকায়ে জারিয়া।” ‘যখন মানুষ মারা যায় তখন তার আমল স্থগিত হয়ে যায়, কেবল তিনটি আমল ছাড়া- সদকায়ে জারিয়া, কিংবা এমন জ্ঞান যা থেকে মানুষ উপকৃত হয় কিংবা এমন সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস-১৬৩১)

‘একজন মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার আমলনামায় যা থেকে নেকি যোগ হবে তা হলো- যদি সে শিক্ষা অর্জনের পর তা অপরকে শিক্ষা দেয় ও প্রচার করে, অথবা সৎ সন্তান রেখে যায়, অথবা ভালো বই রেখে যায়, অথবা মসজিদ নির্মাণ করে দেয়, অথবা মুসাফিরের জন্য সরাইখানা নির্মাণ করে, অথবা খাল-নদী খনন করে দেয় অথবা জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য সম্পদ থেকে সদকা করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-২৪২) আমাদের দেশে উত্তম দানের আরেকটি বড় খাত হলো দুস্থ রোগীর সুস্থ হাসির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করা। আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে নিজেকে অন্যের উপকারে নিয়োজিত রাখতে পারে।

মানুষের উপকার করলে মর্যাদা বেড়ে যায়, নিজে সর্বদা বিপদমুক্ত থাকা যায়, মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয় এবং অহঙ্কার কমে যায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, কেউ যদি এই দুনিয়াতে স্মরণীয়-বরণীয় ও একই সাথে আখিরাতে প্রকৃত কল্যাণ পেতে চায়, তাহলে সবচেয়ে সহজ রাস্তা হলো মানুষের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করা। একজন হাজী মোহাম্মদ মহসিন জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন কেবল দান করে। তার সময়ে তার চেয়ে ধনী লোকের সংখ্যা কম ছিল না। তাদের কারো নাম আমরা জানি না। কিন্তু হাজী মুহম্মদ মহসিন ইতিহাসে অমর। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন- ‘নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, যে ক্ষেত্রে তারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে, তাদের প্রতিদান বর্ধিত করা হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ (সূরা হাদিদ-১৮)

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, ধন-সম্পদ, সমাজে উচ্চ অবস্থান ও প্রতিপত্তি সবই আল্লাহর অনুগ্রহ, দান ও অনেক বড় পরীক্ষা। প্রত্যেকের সম্পদেই নিজ, নিজের পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি অন্যান্য প্রাণিকুলেরও অধিকার আছে। এ জন্য আল্লাহ দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও অসহায়দের জন্য হিস্যা রেখে দিয়েছেন। সুতরাং সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি অনুগ্রহ নয়; বরং এটি তাদের অধিকার। আল্লাহ বলেন- ‘আর যাদের ধন-সম্পদে রয়েছে নির্ধারিত হক, যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতের।’ (সূরা আল-মাআরিজ : ২৪-২৫) ইসলাম পরোপকারের চেতনায় কোনো শ্রেণিভেদ করেনি। ইসলাম বরং বড়-ছোট, ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়, স্বজাতি-বিজাতি, মুসলিম-অমুসলিম এসব ব্যবধানের ঊর্ধ্বে উঠে শান্তি ও সৌহার্দ্যরে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। সমাজবদ্ধ মানুষের পক্ষে এককভাবে বেঁচে থাকা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তাই সমাজের প্রতিটি সদস্যই পরনির্ভরশীল।

ব্যক্তি বা মানব সমাজকে দুষ্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করেও মানুষের প্রভ‚ত উপকার করা যায় এবং এ ধরনের উপকারের কল্যাণ ও সওয়াব অনেক বেশি। তাই সমাজের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি ও অপকর্ম বন্ধ এবং সমাধানের নিয়তে কাজ করার চেষ্টা করাও হলো পরোপকার।
সহযোগিতা ব্যক্তিগত, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়সহ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্নভাবে উপকারের চেয়ে পরিকল্পিত সামাজিক ও সদকায়ে জারিয়া ধরনের উপকার উত্তম। সামাজিক উপকার যেমন- মাদকমুক্ত সমাজ গড়া, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত করা। যৌতুকমুক্ত সমাজ গড়া। যৌতুক দেয়া এবং নেয়ার কুফল সম্পর্কে অন্যকে সচেতন করতে কাজ করা। এসিড সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়া। এটি মারাত্মক অপরাধ- তা মানুষকে জানানো। ধর্ষণমুক্ত সমাজ উপহারে কাজ করা। ধর্ষণ ঠেকাতে যথাযথ কাজ করা। স্বাস্থ্যবান সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখা। বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করা, সব ধরনের চিকিৎসায় সার্বিক সহযোগিতা করা। ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে সমাজকে গড়ে তোলা। যেকোনো সামাজিক নির্যাতন রোধে কাজ করা। রাষ্ট্রীয় উপকার মানে ভালো প্রশাসন, দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালন ধরনের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।

প্রকৃতপক্ষে অন্যের উপকারের মধ্যেই আমাদের নিজেদের উপকারটি নিহিত। আমরা যদি কাউকে উপকার করি তবে তা একটি সার্কেল প্রদক্ষিণ করে আমাদের কাছেই ফিরে আসে। বেশি মানুষের হৃদয়ে বেশি সময়ের জন্য বাঁচতে চাইলেও এই দান-খয়রাতই হলো সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর ব্যবস্থা। একজনকে সাহায্য করলে হয়তো দুনিয়া বদলে যাবে না, তবে ওই একজনের দুনিয়া বদলে যাওয়ার কারণে আপনিও নিশ্চিত বদলে যাবেন।

আমাদের সাহায্য হতে হবে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে। এ জন্যই মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘মানুষ আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না জেনেও তাকে সাহায্য করার নামই হচ্ছে মানবতা