আব্দুল্লাহ আল নোমান: কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/ বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/ জানালার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/ মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/ আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়…। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এই গান সন্তানদের মনে বাবার অভাব মনে করিয়ে দেয়, যিনি আমাদের জীবনে বটবৃক্ষের বিশাল ছায়া হয়ে বিরাজ করেন।
বাবা শব্দটি ছোট, তবে এর অর্থ অনেক বিস্তৃত। বাবা শব্দের মাঝেই জড়িয়ে আছে ভালোবাসা, মায়া, নির্ভরতা। আর তাই প্রত্যেক বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। বাবার প্রতি ভালোবাসা জানাতে সারা বিশ্বেই পালিত হচ্ছে দিনটি। প্রতিটি মানুষের জীবনে তাদের মা-বাবাই সবচেয়ে আপনজন। তাদের ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে সন্তানেরা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন। এ জন্যই ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায় গোলাম মোস্তফা তুলে ধরেছেন সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার চিত্র।
বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর- পুত্র তাঁহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর! চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার।…… মরিল বাবর- না, না ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে কয়? মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়!
যেখানে সন্তানের রোগমুক্তির আশায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন একজন বাবা। এমন স্বার্থহীন ভালোবাসা বোধহয় বাবারাই বাসতে পারে।
উপমহাদেশে দেখা যায়, বাবার সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব থাকে সন্তনদের। কিন্তু তাই বলে বাবার ভালোবাসা কম নয়। তিনি তার সারাটি জীবন ব্যয় করেন সন্তানদের পেছনে, পরিবারের পেছনে। একটা সময় ছিল বাবাদের কঠোর শাসনে বড় হতো ছেলে-মেয়েরা। সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসা থাকলেও আবেগ প্রকাশ হতো ওই শাসনের মধ্য দিয়েই। গত কয়েক দশকে, এ অবস্থা অনেক পাল্টেছে। মায়ের মতো বাবাও হয়ে উঠেছেন সন্তানের বন্ধু। শুধু শাসন নয়, বাবারা সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশে আর রাখঢাক রাখছেন না। অন্যদিকে, সন্তানের বেড়ে ওঠায় বাবার ভূমিকার জন্য কেউ কেউ নিজের বাবাকে সুপারহিরো বলতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না। সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই আজ দেশে দেশে পালিত হচ্ছে দিনটি।
জুন মাসের তৃতীয় রোববার প্রতি বছর বিশ্বের ১১১টি দেশে পালিত হয় বাবা দিবস। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই দিবসটি পালন করা শুরু হয়েছে। তবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ সেপ্টেম্বরের প্রথম রোববার বাবা দিবস পালন করে থাকে। প্রতিটি পরিবারই নিজেদের মতো করে পালন করবে দিনটি। সম্মান জানাবে তাদের বাবাকে।
বাবা দিবসের শুরু:
বাবা দিবসের শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় চার্চের মাধ্যমে দিনটির প্রচলন। অন্যরা বলেন, ওয়াশিংটনের ভ্যাংকুবারে প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয়। তবে সাধারণ মত, বাবা দিবসের প্রবক্তা সোনার স্মার্ট ডোড। যখন তার বয়স ১৬, তখন তার মা ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। পরিবারে সোনারই ছিলেন একমাত্র কন্যা। পূর্ব ওয়াশিংটনের এক গ্রামের ফার্মে এরপর থেকে ডোডের বাবা নবজাতকসহ পাঁচটি সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। সোনার বড় হওয়ার পর অনুভব করলেন, ছয়টি সন্তান একা একা মানুষ করতে কী ভীষণ পরিশ্রমই না তার বাবাকে করতে হয়েছে। উইলিয়াম তার মেয়ের চোখে ছিলেন সাহসী, নিঃস্বার্থ একজন ভালো বাবা, যিনি সন্তানদের জন্য নিজের সব সুখ-শখ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সোনার স্মার্ট বিয়ে করেন জন ব্রোস ডোডকে। তাদের সন্তান জ্যাক ডোড জন্মের কিছুকাল পরে সোনারের স্বামীও মারা যান। এ অবস্থায় বাবা আর মেয়েতে মিলেই পুরো জীবন পার করে দেন তারা।
বাবার প্রতি সম্মান জানাতে ‘বাবা দিবস’ ঘোষণার বিষয়টি সোনারের চিন্তায় আসে ১৯০৯ সালে। ‘মা দিবস’-এর অনুষ্ঠানে সে বছর চার্চে যান সোনার ডোড। অনুষ্ঠানে এসেই তার মনে হয় মা দিবসের মতো বাবাদের জন্যও একটি দিবস করা প্রয়োজন, যেখানে মায়েদের মতো বাবাদেরও সম্মান জানানো হবে। প্রকাশ করা হবে ভালোবাসা। যুক্তরাষ্ট্রের স্পোকেন মন্ত্রিসভার কাছে তিনি তার পিতার জন্মদিন ৫ জুনকে বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠান। তার প্রস্তাবের প্রশংসা করলেও মন্ত্রিসভা ৫ জুনকে বাবা দিবস ঘোষণা করতে রাজি হয়নি।
১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য একটা বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। অবশেষে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন বাবা দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন:
বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য প্রতিদিন কিছুটা সময় দিন। সেটা হতে পারে সাধারণ ‘ধন্যবাদ’ বা আপনার জীবনে তার উপস্থিতির জন্য আন্তরিক প্রশংসা। তাকে জানতে দিন আপনি তাকে ও তার প্রচেষ্টাকে কতটা মূল্য দিয়েছেন।
একসঙ্গে সময় কাটান:
আপনার বাবার সাথে প্রতিদিন কিছুটা সময় কাটান। এটি হতে পারে একসাথে খাবার খাওয়া, হাঁটতে যাওয়া, একটি প্রিয় শো দেখা বা এমন একটি শখ বা কাজ করা যা দুজনই উপভোগ করেন। মূল বিষয় হল বন্ধন বজায় রাখা এবং কথোপকথনের সুযোগ তৈরি করা।
কাজে সাহায্য করা:
বাবার কাজে সহায়তার প্রস্তাব দিতে পারেন। এটা হতে পারে তাকে গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করা কিংবা এমন কোনো কাজের দায়িত্ব নেওয়া যাতে তিনি খুশী হবেন । বাবাকে সাহায্য করার আগ্রহ তার প্রতি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ পাবে।
মনোযোগ দিয়ে শুনুন:
আপনার বাবা যখন তার চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা বা উদ্বেগের কথা শেয়ার করতে চান তখন মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তিনি যা বলতে চান তাতে আগ্রহ দেখান। পরে আপনার মতামত দেবেন। আপনার আগ্রহ প্রকাশের অভিব্যক্তিই বাবাকে খুশী করবে।
উদারতা প্রকাশ:
বাবার জন্য কিছু কাজ করে তাকে অবাক করে দিন। সেটা হতে পারে তার জন্য প্রিয় কোনো খাবার বা পানীয় তৈরি। বাবার জন্য এমন বিশেষ কিছু করতে পারেন যার জন্য তিনি আপনার প্রশংসা করবেন। আপনার এমন ছোট ছোট কর্মকাণ্ডতেই বাবাকে বিশেষ বোধ করাবে।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল নোমান
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (সাভার) নিউজটিভি বাংলা।