১৮ বছরের কিশোরী আনিসা আহমেদ আরিফা। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় পার করছেন তিনি। অন্য সবার সঙ্গে বসতে যাচ্ছিলেন এইচএসসি পরীক্ষায়। পরিকল্পনা ছিল প্রশ্নপত্রের প্রতিটি উত্তর নিখুঁতভাবে লিখে সাফল্য অর্জনের। কিন্তু পরীক্ষার দিন সকালে হঠাৎ মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। বমি, দুর্বলতা আর মায়ের শুকিয়ে যাওয়া মুখ– তাকে পরীক্ষাকেন্দ্রের পথেই থামিয়ে দেয়।
সেই মুহূর্তে আনিসা বুঝে যান গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষার দিনেও সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মায়ের পাশে দাঁড়ানো। তাই তো পরীক্ষা শুরু হওয়ার সময়টায় তিনি ছিলেন হাসপাতালে, মায়ের চিকিৎসকের চেম্বারে।
আনিসার বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন মা মুসলিমা আহমেদ সুবর্ণা। তাই তো পরীক্ষা শুরুর দিন বাসা থেকে ইউনিফর্ম পরে ধরেছিলেন মায়ের হাত। তবে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার কেন্দ্রে যেতে পারেননি, মাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল ডাক্তারের চেম্বারে।
লড়াকু সেই আনিসা আজ (রোববার) আবার ফিরেছেন পরীক্ষার হলে। তার চোখেমুখে ছিল আত্মবিশ্বাস, পাশে শিক্ষকদের সহানুভূতি আর বুকভরা সাহস। পরীক্ষা শেষে আনিসার সঙ্গে কথা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই শিক্ষার্থী জানান, গত বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষার দিন নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্রে যেতে না পারায় অংশ নিতে পারেননি। কারণ তার মা দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। তিনি গত তিন মাস ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন মিরপুরের সুস্থতা ডক্টর পয়েন্টের মেডিসিন ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা ইসলাম ইনার চেম্বারে। পরীক্ষার দিন (২৬ জুন) সকাল থেকে তার মা হঠাৎ বমি করতে থাকেন ও দুর্বলতা অনুভব করেন। এসময় আর কেউ না থাকায় মিরপুরের মাজার রোডের বাসা থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই মাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যান।
আনিসা জানান, সুস্থতা ডক্টর পয়েন্ট কোনো হাসপাতাল নয়, একটি চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বার। সেখানে সকাল থেকেই উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসক ডা. ফারহানা ইসলাম ইনা। তিনি তার মাকে ডাক্তারের চেম্বারে রেখে সকাল ১০টার পর পরীক্ষা কেন্দ্রের উদ্দেশে বের হয়ে যান।
এই পরীক্ষার্থীর ভাষ্য, সেই সময় আমি ছিলাম এক দোটানায়– একদিকে মায়ের শারীরিক অবস্থা, অন্যদিকে পরীক্ষা। তবে শেষ পর্যন্ত মায়ের সুস্থতাকেই অগ্রাধিকার দেন আনিসা।
আজ পরীক্ষা শেষে আনিসা আসেন তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি বলেন, আজকের পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। আমি আমার সাধ্যমতো প্রস্তুতি নিয়ে কেন্দ্রে গিয়েছিলাম এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর লিখেছি। আমার শিক্ষকরা আমার পাশে থেকে অনেক সাহস জুগিয়েছেন, যা আমাকে আরও শক্তি দিয়েছে। মা অসুস্থ থাকলেও আমি চেষ্টা করেছি আমার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হতে। আমি আশা করি ভবিষ্যতেও এমন সাহস ও সমর্থন পেয়ে আমি ভালো ফল করতে পারব।
আনিসা আহমেদ আরিফার ঘটনাটি তার কলেজেও নাড়া দিয়েছে। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীরা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, আনিসা আমাদের কলেজের অত্যন্ত মেধাবী ও দায়িত্বশীল ছাত্রী। টেস্ট পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল, যা তার পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের প্রমাণ। তবে শুধু মেধা নয়, সে একজন মানবিক ও সংবেদনশীল মানুষ বলেও প্রমাণ দিয়েছে। একজন কিশোরী যখন নিজের ভবিষ্যতের বড় পরীক্ষাকে পেছনে ফেলে অসুস্থ মায়ের পাশে দাঁড়ায়, সেটি শুধু প্রশংসনীয় নয়, শিক্ষণীয়ও।
অধ্যক্ষ মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আনিসা আমাদের এখানে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেছে। পরে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছে। আমরা তার পাশে আছি। তাকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করা হবে। আনিসা তার মেধা দিয়ে আমাদের গর্বিত করেছে, এবার তার মানবিকতা দিয়ে আমাদের মন জয় করেছে। একজন শিক্ষার্থীর জীবনে এমন মুহূর্ত আসতে পারে, যখন বইয়ের পৃষ্ঠার চেয়েও বাস্তব জীবনের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আনিসা সেই পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছে।
অন্যদিকে, চিকিৎসা কেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার আনিসাই সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে মাকে নিয়ে এসেছিলেন। আর ১০টা ১০ থেকে ১০টা ১৫ মিনিটের মধ্যে মাকে রেখে চেম্বার থেকে বের হয়ে যান।
সুস্থতা ডক্টর পয়েন্টের চিফ মার্কেটিং অফিসার মোস্তফা জামাল (আকাশ) বলেন, সেদিন আমরা আসলে এত কিছু খেয়াল করিনি। সকাল সাড়ে ৯টার কিছুর পরে কলেজ ইউনিফর্ম পরা এক তরুণী তার মাকে নিয়ে এসেছিল। অবশ্য, তার মা আমাদের এখানে দীর্ঘদিনের রোগী, চিকিৎসা নিচ্ছেন ডা. ফারহানা ইসলামের তত্ত্বাবধানে। ওইদিন প্রাথমিকভাবে আমরা ইসিজি পরীক্ষা করেছি এবং বিকেল পর্যন্ত এখানে তাকে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলাম। পরে কিছুটা সুস্থ অনুভব করার পর তিনি বাসায় ফিরে গেছেন। পরে আমরা নিউজের মাধ্যমে দেখেছি ওই তরুণীই পরীক্ষা দিতে পারেননি। মানবিক বিবেচনায় সে যদি পরীক্ষা দিতে পারে সেটা আমাদেরও ভালো লাগবে।
বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রাতে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে একটি মানবিক পোস্ট দেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট (ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল) মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। এইচএসসি পরীক্ষার্থী আনিসার সঙ্গে আমার মাত্র কথা হয়েছে। তার নাম আনিসা আহমেদ। আনিসার অসুস্থ মা এবং তার কলেজ ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. আসাদুজ্জামান স্যারের সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রদলের কর্মী শিব্বির আহমেদ উসমানি।’
তিনি আরও লেখেন, আনিসার বাবা দুই বছর আগে মারা গেছেন। এখন তার একমাত্র ভরসা হচ্ছে এই মেয়ে। অসুস্থ মাকে দেখাশোনার দায়িত্ব আনিসার কাঁধেই। কলেজের শিক্ষকরা তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছেন। আজ তারা শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও তা সম্ভব হয়নি। বিশেষ বিবেচনায় যেন আনিসার আজকের পরীক্ষা পরে গ্রহণ করা যায়, সেজন্যও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
রুহুল কুদ্দুস কাজল জানান, আমি আইনগত সহায়তার বিষয়ে আনিসাকে আশ্বস্ত করেছি। ২০০০ সালে মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১৩২ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা দেওয়ার নজির তাদের জানিয়ে দিয়েছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তুতি আমার রয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে ব্যারিস্টার কাজল আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, যেভাবে সাধারণ মানুষ আনিসার পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা বোর্ডও মানবিক বিবেচনায় তার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেবেন। যেন এই মেয়েটিকে আদালতের দ্বারস্থ হতে না হয়।
বিষয়টি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, আমরা বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় নিয়েছি। ওই শিক্ষার্থী (আনিসা) আজকের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। আপাতত আমরা চাই সে বাকিগুলো শান্তভাবে সম্পন্ন করুক। তাকে মানসিকভাবে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তী পরীক্ষাগুলোর পর বিষয়টি পুরোপুরি যাচাই করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেকোনো সিদ্ধান্ত হলে যথাসময়ে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সারা দেশে একযোগে শুরু হয় ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। মোট ২ হাজার ৭৯৭টি কেন্দ্রে অংশ নিচ্ছেন প্রায় ১২ লাখ ৫১ হাজার পরীক্ষার্থী। প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিল ১৯ হাজার ৭৫৯ জন শিক্ষার্থী। আর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয় ৪৩ জনকে।
প্রসঙ্গত, এইচএসসি ও সমমানের লিখিত পরীক্ষা শেষ হবে ১০ আগস্ট। এরপর ১১ থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে ব্যবহারিক পরীক্ষা।