1. numanashulianews@gmail.com : kazi sarmin islam : kazi sarmin islam
  2. islamkazisarmin@gmail.com : newstv : Md newstv
  3. admin@newstvbangla.com : newstvbangla : Md Didar
ব্যতিক্রমী জামে মসজিদ, মাস শেষে হাতে মেলে ‘আমলনামা’ - NEWSTVBANGLA
মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৫১ অপরাহ্ন

ব্যতিক্রমী জামে মসজিদ, মাস শেষে হাতে মেলে ‘আমলনামা’

প্রতিনিধি

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সবুজে ঘেরা জিন্দা পার্কের ভেতরে এক বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যতিক্রমী জামে মসজিদ। মসজিদের স্থাপত্য যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি এর নিয়ম-কানুনও অভিনব। এখানে শুধু নামাজ পড়লেই হয় না, উপস্থিতি রেকর্ড করা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ডিজিটাল হাজিরার মাধ্যমে। আর সেই হাজিরা থেকে তৈরি হয় এক ধরনের ‘আমলনামা’। মাসের শেষে স্টাফরা নিজেরাই দেখতে পারেন, মাসে কত ওয়াক্ত নামাজ তারা পড়েছেন।

এই নিয়ম জিন্দা পার্কের স্টাফ ও পার্কের ভেতরে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য। পার্কে কর্মরত কেউ যদি নিয়মিত নামাজ না পড়েন, তাহলে তার বেতনের নির্দিষ্ট অংশ কেটে নেওয়া হয়। আবার যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন, তারা পান বিশেষ প্রণোদনা। মসজিদ কর্তৃপক্ষের ভাষায়, এ ব্যবস্থা মূলত ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি সততা ও নৈতিকতার চর্চা বাড়ানোর জন্য।

২০০৮ সালে অগ্রপথিক পল্লী সমিতির উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় এই মসজিদটি। সমিতির লক্ষ্য ছিল, এলাকার মানুষকে ধর্মভীরু ও নৈতিকভাবে সচেতন করে একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা।

মসজিদে ঢুকতেই চোখে পড়ে প্রবেশদ্বারের মুখে তিনটি ছোট গম্বুজ। আর মূল দালানের ওপর রয়েছে একটি বড় গম্বুজ। দূর থেকেই মসজিদের সৌন্দর্য নজর কাড়ে। মসজিদের সামনের খোলা ময়দান নামাজের সময় ভরে ওঠে মুসল্লিদের সমাগমে। উত্তরের দিকে রয়েছে অজুখানা ও হাম্মামখানা। একই পাশে রয়েছে নারীদের জন্য আলাদা নামাজের স্থান।

এর বিশেষত্ব হলো, মসজিদে কোনো দরজা-জানালা নেই। এটি পুরোপুরি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে যাতে গরমের সময়ও ভেতরে শীতল পরিবেশ থাকে। পাশাপাশি, যেকোনো সময় মুসল্লিরা অবাধে মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করতে পারেন।

প্রবেশদ্বারের পাল্লাগুলো তৈরি হয়েছে লোহা কাঠ দিয়ে। মসজিদের ভেতরের মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে দামি সেগুন কাঠ। পুরো মসজিদে রয়েছে ৯টি প্রবেশদ্বার। মসজিদের দেয়ালে খেজুরগাছের নকশা খোদাই করে আঁকা হয়েছে, যা মোঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর ছোঁয়া এনে দিয়েছে।

এই মসজিদে ঢুকে নামাজ পড়তে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হয়। জিন্দা পার্কের স্টাফ ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি ওয়াক্ত নামাজে হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এ নিয়ে পার্কের স্টাফ কামরুজ্জামান বলেন, “আমরা চাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভালো কিছু রেখে যেতে। সততা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা — এই তিনটি গুণ থাকলেই একটি আদর্শ সমাজ গড়ে ওঠে। তাই এখানে সবাইকে নামাজ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদি কেউ নিয়মিত নামাজ না পড়ে, তার বেতন থেকে জরিমানা কাটা হয়। আর যদি নামাজ পড়তে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে সে এখানে চাকরি করতে পারবে না, সমিতির সদস্যও থাকতে পারবে না।”

‘প্রতিদিনের হাজিরা সংরক্ষণ করা হয় ডিজিটাল সিস্টেমে। মাসের শেষে প্রতিটি কর্মীর আমলনামা তৈরি হয়। এতে দেখা যায় মাসজুড়ে তিনি কত ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন। কেউ নিয়মিত নামাজ পড়লে তাকে প্রণোদনা দেওয়া হয়। অন্যদিকে যারা নামাজে গাফিলতি করেন, তাদের বেতনের পাঁচ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়।’

জিন্দা পার্ক জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাকালীন মুয়াজ্জিন নাজিমুদ্দিন গাজী বলেন, ‘এখানে যারা চাকরি করেন, তাদের তিনটি বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে — পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সত্যবাদিতা আর নামাজ। হাজিরা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো আখেরাতের জন্য আমাদের আমল সংরক্ষণ করা। সবাই যেন নামাজী হয়ে যায়, সে লক্ষ্যেই এই নিয়ম চালু করা হয়েছে।’

স্টাফ বাদল শিকদার বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিদিন ফজরের নামাজ থেকে হাজিরা দেওয়া শুরু হয়। ফজরের নামাজ পড়লে বাকি ওয়াক্তের নামাজ পড়ার আগ্রহ জাগে। যদি কেউ নামাজ না পড়ে, তাহলে তার বেতন থেকে পাঁচ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়। প্রতিমাসের পাঁচ তারিখে কমিশন মিটিংয়ে এই জরিমানা কার্যকর করা হয়। আগে অনেকেই নামাজে অনিয়ম করতেন। কিন্তু এখন নিয়মিত নামাজ পড়েন সবাই।’

শুধু মসজিদ নয়, পার্কের লাইব্রেরিতেও হাজিরা দেওয়ার নিয়ম আছে। দুই স্থানেই স্টাফদের ডিজিটাল হাজিরা দিতে হয়। এর ফলে শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হয়।

মসজিদের ইমাম মাওলানা নাজিবুল্লাহ বলেন, “এখানে শুধু ধর্মীয় অনুশাসন নয়, সমাজসেবামূলক কাজও হয়। অগ্রপথিক পল্লী সমিতির মাধ্যমে পার্কে স্কুল, ক্লিনিক, নার্সারি, কবরস্থান, গরুর খামারসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এই সমিতির প্রধান লক্ষ্য হলো সততা এবং ধর্মভীরতার মাধ্যমে একটি সুস্থ সমাজ গঠন। মুসলিম স্টাফদের জন্য নামাজ বাধ্যতামূলক। প্রতিটি ওয়াক্তের হিসাব রাখা হয়। আর মাস শেষে সেই হিসাব থেকে জানা যায় কে কতটা নামাজ পড়েছেন। যারা নিয়মিত নামাজ পড়েন তাদের উৎসাহিত করা হয়, আর যারা গাফিলতি করেন তাদের সতর্ক করা হয় এবং প্রয়োজনে বেতন কেটে নেওয়া হয়।”

তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নামাজকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছেন। শুধু নামাজ পড়ার কথা নয়, নামাজকে প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন। তাই আমরা এ নিয়ম চালু করেছি। মুসলমানদের মধ্যে নামাজের গুরুত্ব বাড়াতে এ ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন। শহরে হয়তো এ ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব নয়, তবে গ্রামীণ এলাকায় প্রতিষ্ঠানভিত্তিকভাবে তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।’

জিন্দা পার্কের ভেতরে রয়েছে লিটল এনজেলস সেমিনারি। এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসনের ওপরও জোর দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির ধর্ম শিক্ষক নাসিরউদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যও ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থা আছে। আমরা চাই তারা ফজরের নামাজ দিয়ে দিন শুরু করুক। ফজরের নামাজ যদি নিয়মিত আদায় করা যায়, তাহলে বাকি নামাজগুলোও সহজে আদায় হবে। মাস শেষে শিক্ষার্থীরাও নিজেদের নামাজের রিপোর্ট দেখতে পারে। এতে তাদের ভেতরে উৎসাহ জাগে এবং তারা ধর্মীয়ভাবে শৃঙ্খলিত হয়।’

মুসলিম কর্মীদের নামাজে বাধ্যতামূলক করার এই নিয়ম নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে মসজিদের ইমাম নাজিবুল্লাহ মনে করেন, এটি কোনো জবরদস্তি নয়, বরং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের এক প্রয়াস। তিনি বলেন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। তাই একে নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের এবং পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ এই আয়াতের আলোকে আমরা চাই আমাদের সহকর্মীরাও হেদায়াতের পথে থাকুক।

জিন্দা পার্কের এই উদ্যোগ অনেকের জন্য উদাহরণ হতে পারে। গ্রামীণ এলাকায় বা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের নিয়ম চালু করা গেলে মানুষকে নামাজমুখী করা সহজ হবে।

একদিকে যেখানে দেশের অনেক মসজিদ ফাঁকা পড়ে থাকে, সেখানে এই মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ভরে ওঠে কাতার। কারণ, এখানে নামাজ কেবল ইবাদত নয়, বরং জীবনের অংশ।

এই অনন্য ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জিন্দা পার্ক শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়, বরং একটি আদর্শ সমাজ গঠনের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিটি মানুষ ধর্ম, সততা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করে গড়ে তুলছেন — ঠিক যেমনটি স্বপ্ন দেখেছিলেন মসজিদের প্রতিষ্ঠাতারা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2015
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তাহোস্ট