অর্থনীতির গতিময় চাকায় তাঁত শিল্পের ক্রমবর্ধমান অবদান

রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর। আর এই শাহজাদপুরের বেশিরভাগ বসবাসকারীর ঘুম ভাঙ্গে তাঁত কারখানার খটখট শব্দে। সেই শব্দ খানিকটা বিরক্তির উদ্রেক করলেও অন্যরকম অনুভূতি যোগায় আমাদেও মাঝে। সেই শব্দেই যেন আমরা খুঁজে পাই অর্থনীতির গতিময় চাকার খটখট শব্দে অবিরাম ছুটে চলা। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্প ক্রমাগত অবদান রেখে চলেছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক হস্তচালিত তাঁতে বছরে প্রায় ৭০ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয় যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ মিটিয়ে থাকে। বছরে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন করে থাকে।
সিরাজগঞ্জ জেলা ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, তাঁত শুমারী ২০০৩ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫ লক্ষাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে আর ১ লক্ষ ৩৫ হাজারের অধিক রয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলাতে। সিরাজগঞ্জ জেলায় তাঁতী পরিবারের সংখ্যা মোট ১৪,৮৭০ এবং তাঁত সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতিবছর এ জেলায় হস্ত চালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়া এ শিল্প সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ৩ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁতীরা শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, থান কাপড়, থ্রি পিচ, গ্রামীণ চেক সহ বিভিন্ন প্রকার বস্ত্র উৎপাদন করে থাকে। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, শাহজাদপুর উপজেলায় মোট তাঁতি পরিবারের সংখ্যা হল ৪,৯৬১ টি, মোট চালু তাঁত কলের সংখ্যা ৩৪,৬৪৪ টি, বন্ধ তাঁত কলের সংখ্যা ১৩,১৯৫ টি। যদিও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে হস্তচালিত অনেক তাঁত কারখানা বন্ধ হয়েছে আর দিন দিন পাওয়ার চালিত তাঁত কারখানা ফিরছে। সূতা, রং, কেমিক্যালসহ তাঁত বস্ত্র উৎপাদনের সকল উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে অনুপাতে উৎপাদিত কাপড়ের মুল্য বৃদ্ধি পায়নি। ফলে অনেকেই তাঁত শিল্প থেকে বের হতে চাইছেন। এরপরেও এখানকার মানুষের জীবনে তাঁত নিবিড়ভাবে জড়িত। বেশিরভাগই জড়িতদের আয়ের একমাত্র উৎস এই তাঁত। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের তাঁতের বাইরে অন্য উপায়ে আয়ের ব্যবস্থা আছে। শাহজাদপুর পৌরসভাটি মোটামুটি প্রগতিশীল ও কাজের পরিধির তুলনায় বেশ বড়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ উপজেলার তুলনায় এখানে অনেকবেশি অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে। অধিকাংশ ভূমি নিচু হওয়ায় এখানে অনেকটা গাদাগাদি করেই বেড়ে উঠেছে হাটবাজার ও আবাসন এলাকা। বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে এখানে মানুষ ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন রকম কার্যক্রমে। করোনার সময়ে তাঁত কারখানাগুলোর কলের চাকা থমকে গেলেও এখন আবারো খট খট শব্দে মুখরিত শাহজাদপুর, চলতে থাকে সারি সারি সূতো শুকানো আর জ্বলন্ত উনুনে সুতোয় রং লাগানোর ব্যস্ত আয়োজন। সপ্তাহের নিয়মিত কাপড়ের বাজারে আনাগোনা চলে বিভিন্ন জেলা হতে আগত ব্যবসায়ীদের। শাহজাদপুরে একসময় হস্তচালিত লুম থাকলেও এখন পাওয়ারলুম বেশি চলে। এর মধ্যদিয়েই শ্রমিকেরা তাক্রে জীবন নির্বাহ করে। অনেক তাঁত ব্যবসায়ীর আয়ের উৎস শুধু এই ব্যবসাটাই। ব্যবসায় অর্থের যোগান মেটান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। তবে অনেকেই ব্যাংকখাত থেকে ঋণ নেয়াটা ঝামেলার মনে করেন। তাই তারা নিজের যতটুকুবিক্রি থেকে আসে ততটুকুই দিয়ে উৎপাদন চালান। বিভিন্ন কাঁচামাল বাকিতে নিয়ে আসেন এবং বছরশেষে হালখাতার মাধ্যমে পরিশোধ করেন। কখনো সমস্যায় পড়লে তাঁত সমিতিতে আলোচনা হলেও তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়না। সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সেগুলো সম্পর্কে তাঁত মালিকেরা জানেন না বা তাদের কাছে পৌছায়না।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু কাপড়ের বাজারের মধ্যে শাহজাদপুরের বাজার একটি। কাপড় ব্যবসা মূলত ভালো চলে ৩ মাস। শবে বরাত বা বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে প্রায় ২০ রমজান পর্যন্ত চলে। রমজান ঈদের পরে কোরবানী ঈদের আগে আর পূজোর একটা মাস বিক্রি হয়। কোভিড-১৯ যেমন শ্রমিকদের উপরে প্রভাব ফেলেছিল ঠিক তেমনিভাবেই তাঁত মালিক ও কাপড় ব্যবসায়ীদের উপরেও ফেলেছে। তবে শ্রমিকদের মত যারা দিন আনে দিন খায় তারাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
লেখকঃ
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
একাউন্ট & ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ।
ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।